নবী সা:-এর ভবিষ্যদ্বাণী
মুহিউদ্দীন খান
আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: কেয়ামতকাল পর্যন্ত
তাঁর উম্মতের জন্য চলার পথ নির্দেশ করে গেছেন। কালের বিবর্তনে যেসব বৈরী
সময় উপস্থিত হবে সেগুলোর স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত করার উদ্দেশ্যেও তিনি এমন
কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন যেগুলো একটু মনোযোগসহকারে পাঠ করলে মনে হবে
যেন প্রতিটি ঘটনাই আগাগোড়া স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে উম্মতকে সে সম্পর্কে
সতর্ক করে গেছেন। হাদিস শরিফের কিতাবাদিতে সতর্কবাণীমূলক এ অধ্যায়টিকে
‘ফেতান’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘ফেতান’ ফেতনাতুন শব্দের বহুবচন। আভিধানিক
অর্থ, স্বর্ণ আগুনে জ্বালিয়ে তার ভালোমন্দ পরীক্ষা করা। যেহেতু নানা ধরনের
বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের ঈমান এবং আমলের পরীক্ষা হয়ে যায়, সে
কারণে সব ধরনের বৈরী পরিস্থিতিকেই ফেতনা বলা হয়ে থাকে। মন্দ ধরনের কোনো
আমল যখন সে জমানার একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়ে যায় এবং বুঝে, না বুঝে মানুষ
তা অনুসরণ করতে শুরু করে তখন সেটিকেও একটি ‘ফেতনা’ নামে অভিহিত করা হয়ে
থাকে। কেননা এর দ্বারাও মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয়ে যায়। কারা এ ফেতনার
মধ্যে নিজেকে সমর্পিত করে দেয়, আর কারা এ পরিস্থিতি সাহসের সাথে মোকাবেলা
করে ঈমানের ওপর দৃঢ়পদ থাকে, সেটা দেখার একটা সুযোগ উপস্থিত হয়। অনুরূপ
ইসলামের মূল চেতনাবিরোধী কোনো চিন্তাধারা যখন আকর্ষণীয় যুক্তির আবরণে
সুসজ্জিত করে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয় তখন সেটাও একটা ফেতনা
হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এর দ্বারা মানুষের পরীক্ষা হয়ে যায় যে, সে কি স্থূল
যুক্তি এবং বাহ্যিক চাকচিক্যের সামনে পরাজয় স্বীকার করে, না সুষ্ঠু
যুক্তি ও চিন্তার দ্বারা এ স্থূল চিন্তাধারার মোকাবেলা করে। হজরত নবী করিম
সা: ফেতনার প্রতিটি দিক সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। তৎসঙ্গে এ কথাও
সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, উম্মত যখন এসব ফেতনার সম্মুখীন হবে তখন তার
কর্তব্য কী হবে! এ সম্পর্কিত বর্ণনার ধরন এবং আধিক্য এ কথা প্রমাণ করে যে,
হজরত নবী করিম সা: ভবিষ্যতের এসব ফেতনার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।
একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, আমার দু’চোখ দেখতে পাচ্ছে ফেতনা তোমাদের প্রতিটি
জনপদেই এমনভাবে পতিত হয়, যেমন করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরতে থাকে (বোখারি
কিতাবুল-ফেতান)।নবী করিম সা: এরশাদ করেছেন, সময় অতি দ্রুত অতিবাহিত হবে। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এক-একটি বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটে যাবে। সৎ কাজ কমে যাবে। দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান দ্রুত হ্রাস পাবে। অজ্ঞতা ও মূর্খতা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়বে। সহীহ শুদ্ধ এলম উঠে যেতে থাকবে। অর্থলিপ্সা, লোভ-লালসা ও কার্পণ্য সাধারণ চরিত্রে পরিণত হয়ে যাবে। সর্বত্র হত্যা ও লুণ্ঠনের ছড়াছড়ি দেখা দেবে (বোখারি, কিতাবুল-ফেতান, পঞ্চম অধ্যায়)।
* নেশাদ্রব্য মদকে নির্দোষ পানীয়রূপে সাব্যস্ত করা হবে। সুদকে ব্যবসারূপে অভিহিত করে হালাল সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা চলবে। ঘুষকে উপঢৌকন বলে হালাল সাব্যস্ত করা হবে। জাকাতকে বাণিজ্যে পরিণত করা হবে। অর্থাৎ একশ্রেণীর লোক জাকাত উসুল করে বিভিন্ন পন্থায় তা দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে (কানজুল-উম্মাল, চতুর্দশ খ -পৃ: ২২৬)।
মানুষ সন্তানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করাটাকে ঘৃণার চোখে দেখবে। বৃষ্টির দ্বারা জমিন শীতল না হয়ে বরং গরম বেড়ে যাবে। ব্যভিচারের বন্যা বইতে থাকবে। মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী বলা হবে। আত্মৎসর্গকারীকে আমানতদার এবং প্রকৃত আমানতদারকে আত্মোৎসর্গকারী বলা হবে। অনাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক গভীরতর হবে এবং আত্মীয়- এগানার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব চলে যাবে দুষ্কৃতকারীদের হাতে। প্রকৃত মুমেন ব্যক্তিকে সমাজ ছোট ছোট ছাগলছানার মতো নিতান্ত স্বল্পমূল্যের মনে করা হবে। মসজিদের মেহরাব কারুকার্যমণ্ডিত হবে, কিন্তু দিল হবে অন্তঃসারশূন্য। সমকামের ব্যাপক প্রচলন হবে। পুরুষ-পুরুষের সাথে এবং নারী-নারীদের কামলীলা চরিতার্থ করবে। বিরাট বিরাট এলাকা নিয়ে মসজিদ নির্মিত হবে এবং সেগুলো সুউচ্চ মিনার দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে। জনমানবহীন বিরান এলাকা আবাদ হয়ে যাবে এবং অনেক জনবহুল আবাদি বিরান হয়ে যাবে। সর্বত্র পুলিশি রাজত্ব কায়েম হবে। অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতির পেছনে লেগে থাকা, চোগলখুরি ও অন্যের দোষচর্চা ব্যাপকতর হয়ে যাবে। গান বাদ্য ও প্রকাশ্যে মদ্যপান বেড়ে যাবে (কানজুল-উম্মাল, চতুর্দশ খ )।
নিয়মিত নামাজ পড়ার প্রচলন কমে যাবে। আমানতের ব্যাপক খেয়ানত হবে। সুদখোরীর প্রচলন ব্যাপকতর হবে। মিথ্যাচারকে বৈধ জ্ঞান করা হবে। মানুষের জীবনের মূল্য সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যাবে। সুউচ্চ ইমারত নির্মিত হতে থাকবে। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে দ্বীন বিক্রয় করে দেয়া হবে। সুবিচার বিলুপ্ত প্রায় হয়ে যাবে। চার দিকে শুধু জুলুম আর অবিচারের রাজত্ব কায়েম হবে। তালাকের ঘটনা ব্যাপক হবে। অপমৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। একে অপরের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবে। ইতর শ্রেণীর লোকদের ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটবে আর ভদ্র বিনীত লোক খুব অল্পই অবশিষ্ট থাকবে। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রীরা পর্যন্ত মিথ্যা বলবে। জনগণের সম্পদ হেফাজতকারীরা আত্মসাৎকারী হবে। জাতির প্রতিনিধি স্থানীয় লোকগুলো হবে জালেম। দুশ্চরিত্র লোকেরাও কুরআনের ক্বারীরূপে পরিচিত হবে। জীবজন্তুর চামড়ার তৈরী পোশাকের প্রচলন হবে। ওদের অন্তর পচা লাশের চেয়েও বেশি দুর্গন্ধযুক্ত হবে। শান্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কুরআন শরিফ বর্ণাঢ্যভাবে মুদ্রণ করা হবে। সুউচ্চ মিনারসংবলিত সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মিত হবে। কিন্তু মানুষের দিল উজাড় হয়ে যাবে। কুরআনের আইন বাতিল করে দেয়া হবে। কন্যারা পর্যন্ত মায়েদের সাথে দাসী-বাঁদীর মতো আচরণ করবে। যেসব- লোকের পরনের কাপড় জুটত না, ওরা শাসন কর্তৃত্বের মালিক হয়ে বসবে। স্ত্রীলোকেরাও স্বামীর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায়-বাণিজ্য করবে। পুরুষেরা স্ত্রীলোকের এবং স্ত্রীলোকেরা পুরুষের বেশ ধারণ করে প্রকাশ্যে চলাফিরা করবে। আল্লাহর নাম বাদ দিয়ে অন্যের নামে কছম খাওয়া হবে। মুসলমানেরাও মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে। দ্বীনি এলেম আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে অর্জন না করে অন্য কোনো স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অর্জন করা হবে। জাতীয় কোষাগার ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে। আমানতকে লুটের মাল জ্ঞান করা হবে। জাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে। সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট চরিত্রের লোকগুলোই নেতৃত্বের আসন দখল করে ফেলবে। সন্তান পিতার অবাধ্য হয়ে যাবে, মায়ের সাথে নির্মম আচরণ করবে। বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা না করে ক্ষতি করার ফিকিরে থাকবে। অধিকাংশ লোক স্ত্রীর একান্ত অনুগত হয়ে জীবনযাপন করবে।
চরিত্রহীন লোকেরা মসজিদের মধ্যেও বড় গলায় কথা বলবে। পয়সাওয়ালা লোকেরা গায়িকা নর্তকীদের রক্ষিতা করে রাখবে। গানবাদ্যের সাজসরঞ্জাম যতেœর সাথে সংরক্ষণ করা হবে। প্রকাশ্যে রাস্তায় বসে লোকেরা মদ পান করবে। জুলুম করে গর্ব প্রকাশ করা হবে। কোর্টকাচারির বিচার পর্যন্ত কেনাবেচা হবে। কুরআন তিলাওয়াতকে সঙ্গীতের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে। আগের জমানার লোকদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা হবে (আদ দুররুল মনসুর, ষষ্ঠ খণ্ড)।
কলমের ব্যবহার (অর্থাৎ লিখিত পঠনসামগ্রী) ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। প্রকৃত সত্য গোপন করা হবে। লোকেরা মসজিদে আসবে সত্য কিন্তু দুই রাকাত (নফল) পড়ার তওফিক হবে না। একটি ছোট শিশুও একজন বৃদ্ধকে শুধু গরিব মনে করে লাঞ্ছিত করবে। এমন দুশ্চরিত্র লোক সৃষ্টি হবে, যারা পরস্পর দেখাসাক্ষাতের সূচনা করবে সালাম দেয়ার পরিবর্তে গালিগালাজের মাধ্যমে। লোকেরা নরম গদি আঁটা বাহনে আরোহণ করে ঠাটবাটের সাথে মসজিদের দ্বারে এসে অবতরণ করবে। তাদের স্ত্রীলোকরা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গপ্রায় হয়ে চলাফেরা করবে। ওদের মাথায় কৃশ উটের কুঁজের মতো চুল বাঁধা থাকবে (আদ্দুররুল-মনসুর, ষষ্ঠ খণ্ড)।
দ্বীনের বিধিবিধান সম্পূর্ণ উল্টে দেয়া হবে। অর্থাৎ হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করে দেয়া হবে (মিশকাতুল-মাসাবিহ)।
মুসলমানরা ইহুদি নাসারাদের চালচলন অনুসরণ করতে থাকবে (মেশকাতুল-মাসাবিহ)।
আমানত রক্ষা করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। লোকেরা এরূপ বলাবলি করবে যে, অমুক জায়গায় একজন আমানতদার লোক বাস করেন। ওই সব লোকের সাহস, উদ্দীপনা এবং কর্মশক্তির তারিফ করা হবে, যাদের অন্তরে সরিষা বরাবরই ঈমান থাকবে না (বোখারি দ্বিতীয় খণ্ড)।
নিতান্ত অযোগ্য বাজে লোকেরাও জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে রায় দিতে শুরু করবে (কানজুল উম্মাল, চতুর্দশ খণ্ড)।
হজরত নবী করিম সা: ফেতনার জমানা এবং সে জমানায় যেসব ঘটনা ঘটবে সে সম্পর্কিত যেসব ইশারা-ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন সেগুলোর মধ্য থেকে একটা সামান্য অংশই এখানে পরিবেশন করা হলো। ফেতনা সম্পর্কিত সব হাদিস একত্র করা গেলে দেখা যাবে যে, বর্তমান যুগের ব্যাপক অবক্ষয়গুলো যেন প্রিয় নবীজী এক-এক করে চৌদ্দ শ’ বছর আগেই বলে গেছেন। আজকের যুগের সার্বিক অবস্থাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কী চমৎকারভাবেই না এ যুগের যাবতীয় অসভ্যতা, অনাচার ও অবক্ষয়ের চিত্রগুলো সে ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক মদীনা
No comments:
Post a Comment