‘একাত্তরের শত্র“’ উচ্ছেদের নামে নয়া এজেন্ডা
বিচিন্তা
সাদেক খান
এ বছর ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের
দায়ে বর্তমানে ফেরার একজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হয়। আসামির
অবর্তমানে প্রায় সম্পূর্ণ একতরফাভাবে প্রধানত শোনা কথার সা্েযর ভিত্তিতে
এবং চাুস সা্েযর দাবিদারদের জেরা ব্যতিরেকেই ওই ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হয়েছে।
রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামিপরে উকিল নিজেই বলেছেন, আসামির অবর্তমানে এবং আসামির
আত্মীয়স্বজনের ‘অসহযোগিতা’র কারণে তিনি মামলায় লড়তে পারেননি, কোনো সাফাই
সাী খুঁজে পাননি। এভাবে অভিযুক্তের অবর্তমানে কিংবা তার আত্মপ সমর্থনের
যথাযথ সুযোগদান ছাড়াই একজন ধার্মিক ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশদান
ন্যায়সঙ্গত নয়, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য প্রদত্ত বলে প্রশ্ন তুলেছেন
বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার
মাহবুব হোসেন।আন্তর্জাতিকভাবে ওই বিচারপ্রক্রিয়া এবং বিচারিক আদালত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালদ্বয় সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন আন্তর্জাতিক আইনবিদ ইউনিয়ন বা আইজেইউ। ওই ৩২-জাতি সংস্থা প্রেরিত ১৪ জন নিরপে স্বনামখ্যাত আইনবিদ নিয়ে গঠিত একটি কমিশন পাঁচ দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসে। তারা আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকারপরে প্রধান উকিল, প্রধান বিরোধী দল প্রতিনিধি, বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, তদন্তকারী দলের প্রতিনিধি ও আসামিপরে উকিলদের সাথে সাাৎ করেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার একটি শুনানিতে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকেন। আইজেইউ’র প্রতিনিধিদল পর্যবেক্ষণ শেষে সব কিছু নতুন করে খতিয়ে দেখতে বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালদ্বয়ের এখতিয়ার, বিচারিক গুণাগুণ ও বিচারপদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানে কতটা ন্যায়নিষ্ঠ সে ব্যাপারে আবার প্রশ্ন তুলেছে। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আরো প্রশ্ন তোলা হয় (সংিেপত) : ‘২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে ’৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য যে আদালত গঠন করা হয় সেটি কোনো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারী নয়; ১৯৭৩ সালে পাস করা বাংলাদেশের একটি আইন (দালাল আইন) ২০০৯ ও ২০১২ সালে সংশোধনের বদৌলতে মতায়িত। যুদ্ধাপরাধের শিকার এবং যুদ্ধাপরাধী উভয়ের জন্যই খুব দেরিতে সুবিচারের এই তল্লাশি শুরু হয়েছে; তবে (চলতি ফৌজদারি আইনের ৪২ বছর আগের এই অপরাধ বিশ্বস্ত সা্েযর অভাবে তামাদি গণ্য হলেও) যুদ্ধাপরাধ তামাদি হয় না।’ কিন্তু বিচারের স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ওই কমিশন বাংলাদেশ সফর শেষে ২৬ জানুয়ারি আইজেইউ কর্তৃপরে কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিরপে বা ন্যায়নিষ্ঠ নয়। দেশজ আইনেরই নানা অধিকারবঞ্চিত করা হচ্ছে আটককৃত অভিযুক্তদের। ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা, সরকারি উকিলপ ও তদন্তকারী সংস্থার সদস্য সবাই (রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায়) বর্তমান সরকার-নিযুক্ত। বিগত নির্বাচিত সরকারের একজন মন্ত্রী ও একজন উপমন্ত্রীকে (প্রকৃতপে মন্ত্রী) যেভাবে (’৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধী মামলা তালিকা বহির্ভূতভাবে) আসামি করে আটক রাখা হয়েছে, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি-সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের রোম স্ট্যাটিউট স্বারকারী রাষ্ট্র। স্বচ্ছ ও সুবিচারের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারেরই কর্তব্য ৪২ বছরের পুরনো যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত অভিযোগগুলো তদন্ত করে রোম স্ট্যাটিউটের ৫.১ ধারা মোতাবেক আইসিসি’র দ্বারস্থ হওয়া। যারা রোম স্ট্যাটিউটে স্বারকারী সেসব দেশের মানবতাবিরোধী অপরাধ আমলে নিতে সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক আহূত না হলেও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মোতাবেক রোম স্ট্যাটিউটের ১৩(বি) ধারা বলে আইসিসি সেসব মামলা হাতে নিতে পারে।
আইজেইউ এই সুপারিশ অনুসরণ করলে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ‘নিয়মানুগ বিশ্বব্যবস্থা’ কায়েমের তাগিদে মাওলানা আজাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত যুদ্ধাপরাধের রায়ের বিষয়টি আইসিসির কাছে প্রেরণের তদবির করতে পারে। যেকোনো জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা সেটা করতে পারে। এর আগে দুই বছর ধরেই সংশোধিত দালাল আইন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে নানা ত্র“টির কথা একাধিক বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনবিদ, সংস্থা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে এসে বলে গেছেন, লিখিত প্রতিবেদন পেশ করেছেন তাদের দেশের ও আন্তর্জাতিক মহলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে কাছে। তাদের কিছু কথা আমলে নিয়ে সরকার ২০১২ সালের সংশোধনী দিয়ে অপরাধ বিবেচনাকে আরো ধারালো করেছে; বেশির ভাগ কথাই কানে নেয়নি। বিশেষত ফৌজদারি স্যা আইন শিথিল করে শোনা কথাকে আমলে নেয়ার উল্টো ব্যবস্থা করেছে।
ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ এর সভাপতি তথা বাংলাদেশের এই আদালতে নিযুক্ত প্রথম ও প্রধান বিচারক তার এক সরকারঘনিষ্ঠ প্রবাসী পরামর্শদাতার সাথে নিয়মিতভাবে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে এবং সরকারকে খুশি করা রায়ের পুরস্কার হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে তার প্রমোশনের আগাম প্রতিশ্র“তির জন্য যে ‘স্কাইপে’ সংলাপ চালিয়েছেন, সেটা ফাঁস হয়ে যায়। তাতে ধরা পড়ে সরকারের মন্ত্রীরা কিভাবে তার ওপর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ দিয়ে একটা রায় শিগগির দিয়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন। আরো কথা হয়েছে, সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় কত দুর্বল, প্রবাসী পরামর্শদাতা আইনজ্ঞ একটা রায়ের যেনতেন কাঠামো খাড়া করে দিতে পারেন কি না, অদ বিচারক যারা নিযুক্ত হয়েছেন তাদের চালচলন কেমন বেখাপ্পা ইত্যাদি।
এভাবে স্কাইপ কেলেঙ্কারির ফলে ট্রাইব্যুনাল প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় প্রধান বিচারক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করলেও হাইকোর্টে স্বপদেই ফিরে গেছেন, তার প্রমাণিত নৈতিক বিচ্যুতিকে ‘হ্যাক করা আলামত আমলযোগ্য নয়’ বলে উপো করেছে সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। আসামিপরে উকিলেরা দাবি করেছেন, প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ ও নৈতিক বিচ্যুতির কারণে চলতি ট্রাইব্যুনালগুলো ভেঙে দেয়া উচিত এবং চলতি মামলাগুলো নতুন আদালতে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ শুনানি হওয়া উচিত। সে দাবি অগ্রাহ্য করে অন্য (স্কাইপ সংলাপে বিতর্কিত) বিচারকদের বহাল রেখে শূন্য পদে নতুন বিচারক নিযুক্ত করেছে সরকার। এই প্রশ্নবিদ্ধ ট্রাইব্যুনালে বেছে বেছে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের হুকুমের আসামি করে চটজলদি রায় আদায়ের ‘রাজনৈতিক’ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক রকম এককভাবেই একটা জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে সম হয়েছেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। দাবি করেছেন, অগ্রহণযোগ্য পপাতদুষ্ট ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে তাদের রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেয়া হোক। এই আন্দোলন প্রতিহত করতে সরকারপ প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়েই এক দিকে র্যাব-পুলিশ আর অন্য দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ, অন্য দিকে ঢালাও গ্রেফতার আর তৈরি গ্যাংকেসে জড়িয়ে জেল-জুলুমের ফ্যাসিবাদী কৌশল গ্রহণ করেছে। জেলহাজতগুলো ভরে ফেলা হয়েছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরে এনে। যারা পালাতে পেরেছেন তারা গেরিলা কায়দায় ঝটিকা মিছিল ও ত্বরিত পথসভা করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। হরতালের ডাক দিয়েছেন। নৈতিক সমর্থন দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮দলীয় জোট। হরতালে পুলিশি জুলুম, পিকেটার মনে করে পথচারীর ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা আরো বেড়েছে। পাল্টা সুযোগ পেলেই পুলিশ পিটিয়েছে ছাত্রশিবির কর্মীরা।
তখন ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ’ করতে জামায়াত-শিবিরের আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী’ তৎপরতা আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরের দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি করে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলেছে সরকারপরে একাংশ, মিডিয়ার একাংশ আর সুশীলসমাজের একটা চিহ্নিত মহল। কিন্তু সহিংসতার শিকার হতাহতদের প নিয়ে ব্যাপক আকারে যেসব জেলাওয়ারি, বিভাগওয়ারি এবং দেশব্যাপী হরতাল বিােভের কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবির নেতৃত্ব দিয়েছে বা অংশ নিয়েছে, তাতে জনসাধারণের নীরব সহানুভূতির বিলণ তাৎপর্য শেষ পর্যন্ত উপো করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রাকারী পুলিশ প্রশাসন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও বলে চলেছেন : জামায়াত-শিবির দেখলেই ধরিয়ে দিন, আওয়ামী লীগের ‘লাঠি-বৈঠা’ দিয়ে জামায়াত-শিবির দমন করা হবে, ঢাকায় এবং অন্যত্র পুলিশ প্রশাসন নতুন প্রজন্মের জামায়াত-শিবির নেতাদের সাথে একটা রফা করেছে। ৪ ফেব্র“য়ারি শান্তিপূর্ণভাবেই ঢাকায় এবং অন্য অনেক শহরে সমাবেশ-মিছিল করে তারা প্রমাণ রেখেছে, অকারণ সহিংসতায় তারা বিশ্বাসী নয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তারা প্রতিবাদ জানাতে চায়। আবার যেখানে পুলিশ একগুঁয়েমি করে বা সরকারদলীয়দের উসকানিতে লাঠিচার্জ করে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে প্রতিবাদকারী কর্মীদের তাড়া করেছে, সেখানেই পাল্টা পুলিশকে নাজেহাল হতে হয়েছে। ঢাকায় শান্তিপূর্ণ পুলিশ পরিবেষ্টিত জমায়েত থেকে ঘোষণা হয়েছিল, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সি-এ-ভি বা অপেমাণ রায়ে প্রশ্নবিদ্ধ আদালত পপাতদুষ্ট আদেশ দিলে লাগাতার হরতালের কর্মসূচি দেয়া হবে। আক্রান্ত না হলে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মতো শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের অঙ্গীকার দিয়ে ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে ৫ ফেব্র“য়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণাও দেয়া হয় মিছিলপূর্ব সমাবেশ থেকে।
সেই হরতাল প্রথম দিকে কড়া এবং শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হয়েছে সারা দেশে। তারপর দুপুর সাড়ে ১২টায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঘোষিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়। রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার দ্বিতীয় ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রথম রায়। এই রায় ঘোষণার পর রাজধানীর সড়কগুলো একদম ফাঁকা হয়ে যায়, পথচারীরাও সরে পড়ে। সারা দেশে অন্যান্য শহরে শুরু হয় সরকারদলীয় ‘বাহিনী’র সাথে, কোথাও কোথাও পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষ, রক্তপাত।
মামলার বিবরণ : কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ অনুসারে, তিনি একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। দ্বিতীয় অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৭ মার্চ তিনি সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা জল্লাদখানা পাম্পহাউজে নিয়ে জবাই করে হত্যা করেন। চতুর্থ অভিযোগ অনুসারে, ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচরে (শহীদনগর) শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেন। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালি রাজাকারদের সাথে কাদের মোল্লা মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামে হামলা চালান। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি নিহত হন। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা, তার সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনারা মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে হজরত আলী লস্করের বাসায় যান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হজরত, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়, ধর্ষণের শিকার হয় এক মেয়ে।
ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড; এক, দুই ও তিন নম্বর অভিযোগের জন্য ১৫ বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ এবং চার নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা ২০১০ সালের ২১ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগম। ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপ। গত বছরের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হলে মামলাটি এই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই বছরের ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল-২।
৩ জুলাই থেকে রাষ্ট্রপরে স্যা নেয়া শুরু হয়। দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপে স্যা দেন ১২ জন। পরে আসামিপে প্রথম সাী কাদের মোল্লাসহ ছয়জন স্যা দেন। রাষ্ট্রপ ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিন যুক্তি উপস্থাপন করে। ৭ জানুয়ারি শুরু হয়ে আট দিন চলে আসামিপরে যুক্তি উপস্থাপন। ১৭ জানুয়ারি যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়।
সম্ভবত আইজেইউ কমিশনের প্রতিবেদন এবং নিরাপত্তা পরিষদের হস্তেেপর সম্ভাবনাকে মনে মনে কিছুটা আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা। তাই ‘অসমর্থিত’ অভিযোগকেই আমলে নিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন, ফাঁসির হুকুম দেননি। কিন্তু ‘অগ্রহণযোগ্য’ এই রায় মানি না বলছে উভয়প। বিুব্ধ জামায়াত-শিবিরপ লাগাতার হরতালের ডাক দিয়েছে। আর মতাসীন দলের অভ্যন্তরে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিদারপ আওয়াজ তুলেছে; রায় মানি না, ফাঁসি চাই। সেটাই শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অসংখ্য রাজনৈতিক ইস্যুর মীমাংসার চেয়ে এখন সামনে এসে গেছে বলতে গেলে মতাসীন জোটের তরফেই আরোপ করা ‘একাত্তরের শত্র“’ উচ্ছেদের নামে নয়া এজেন্ডা। এই এজেন্ডা প্রতিরোধে লাগাতার হরতাল দিয়ে প্রতিরোধের সামর্থ্য জামায়াত-শিবিরের আছে কি না, কিংবা বিরোধীপীয় জোটের অন্য শরিকদের সমর্থন তারা পাবে কি না, সরকারি মহলেরই একটা চোরাফাঁদে তারা পা দিয়েছে কি না কিংবা সব ফাঁদ এড়িয়ে তারা টিকে থাকতে পারবে কি না, ভবিষ্যৎই সেটা বলতে পারে।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments:
Post a Comment