ফ্লাট কেনায় এক ডজন পরামর্শনজরুল ইসলাম টিপু |
|
যারা
ফ্লাট কিনতে চায় তাদের অনেকে জানেন না যে ফ্লাট সম্পর্কিত কি কি জিনিষ
গুলো জানা দরকার। ডেভলোপারের কাছে কোন জিনিষগুলো চাইতে হবে এবং কি কি
প্রশ্ন করতে হবে। অনেক ক্রেতা এসব না জেনে ফ্লাট কিনেন, পরে পদে পদে
পস্তাতে থাকে এবং নিজের কপালকে দোষ দেয়। ডেভলোপারদের ফ্লাট বিক্রি করতে হবে
আর ক্রেতাদের তা কিনতে হবে। সুতরাং সকলের জানা উচিত আধুনিক জীবনে কি কি
সুবিধা পেলে একটি নিরাপদ স্বাস্থ্য সম্মত ফ্লাটের মালিক হওয়া যাবে।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
১. প্রতিটি ফ্লাট গ্রহীতাকে তাদের জায়গার প্রকৃত ইতিহাস জানাটা অপরিহার্য। ডেভলোপার থেকে খতিয়ান, মৌজা ও দাগ নম্বর নিয়ে স্থানীয় রেজিস্টার অফিসে গেলে এসব তথ্য পাওয়া যাবে, রেজিস্ট্রি অফিসে জমিটির সকল কাহিনী জানা যাবে। কোন জরিপে কে মালিক ছিল তা দেখে নিতে হবে। জমিটি ডেভলোপার কোম্পানি নেবার সময় বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকা কিংবা স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কিনা জানতে হবে। অনেকে মফস্বলের অখ্যাত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, এমন হলে কোন সুবিধার জন্য করা হয়েছে তা জানা দরকার। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটি মূলত জমি কেনার সময় প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে জমির মালিক যদি রেজিস্টার্ড ডেভলোপার হয়, তাহলে প্রশ্ন করার দরকার হয়না। তবে বাংলাদেশের কয়েকটি ডেভলোপার কোম্পানির কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হবার পর, বুঝা গেল বাংলাদেশে সবই সম্ভব! খাস জমি এবং অতীতে হিন্দুদের নামের জমিতে বাড়ী ঘর তৈরিতে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। তাই অযাচিত হলেও নিজের প্রয়োজনের তাগিদে অনেক কিছুই জানতে হয়। ২. নির্ধারিত জমির মাটি পরীক্ষা কোন কোম্পানি করেছিল? তারা একাজে দক্ষ কিনা? বাজারে তাদের পূর্ব পরিচিতি ও সুনাম আছে কিনা জানতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন কোম্পানি একই এলাকাতে অন্যত্র মাটি পরীক্ষা করেছিল। যার ফলে তাদের কাছে সেখানার মাটি সম্পর্কে ধারনা থাকে। এই সুযোগে তারা লোক দেখানো একটি কাজ করে। পূর্বে করা অন্যের জরিপের ডাটা গুলো কিছুটা এদিক সেদিক করে একটি রিপোর্ট দিয়ে দেয়! বস্তুত তাদের সেই রিপোর্ট ৮০% কাছাকাছি হয় কিন্তু ১০০ ভাগ নিশ্চিত তো আর হয়না। একজন ফ্লাট মালিক এসব তথ্যের ভুল ধরতে পারবে না বটে, তবে নিজেদের কাছে রিপোর্টের একটি কপি থাকা উচিত, ভবিষ্যতে কোন দিন কাজ দিবে। ৩. ফ্লাট মালিকেরা অবশ্যই পুরো ভবনের এক সেট পরিপূর্ণ As Built Drawings নিজ দায়িত্বে ডেভলোপার কোম্পানি থেকে চেয়ে নিবেন। পরিপূর্ণ ভাবে ভবনের কাজ শেষ হলে, ভবন যেভাবে বানানো হয়েছে, যেখান দিয়ে পাইপ চালানো হয়েছে, ইত্যাদি অঙ্কন করে হুবহু অবিকল একটি Drawing বানানো হয় সেটাকে As Built Drawing বলে। সেই ধরনের একটি সেট সংগ্রহ করে পুরো সেটের মাঝে Structural, Architectural, Electrical, Drainage, Water Supply Drawings ভুলক্রমে বাদ পড়েছে কিনা, নিজ দায়িত্বে পরখ করে নিতে হবে। এছাড়াও একটি ভবন তৈরিতে আরো বিভিন্ন নকশা বা Drawing থাকে যেমন Elevation, Section, Details ইত্যাদি। সুনাম পূর্ণ ডেভলোপার কোম্পানি এসব নকশা চাহিবা মাত্র সিডি অথবা প্রিন্ট হস্তান্তর করবেন। মূলত: ফ্লাটের কিংবা ভবনের চিরদিনের ইতিহাস এই ড্রয়িং গুলোতেই লিপিবদ্ধ থাকবে। নির্মাণ ত্রুটির কারণে ভবনে সমস্যা দেখা দিলে, ভূমিকম্পে ফাটল হলে এসব সমস্যা সমাধানে As Built নকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে সুবিধা হবে। কিংবা অন্ধের মত ভবনের অপ্রয়োজনীয় অংশে কাটা ছেড়া করতে হবে। এতে সমস্যার সমাধান না হয়ে জটিলতা বৃদ্ধি পাবে। ৪. যারা ফ্লাট ক্রয় করতে চান, তারা ফ্লাট এবং ভবনের বাহারি দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে যান। তারা ভুলেও জানতে পারেন না যে, ভবন তৈরিতে মালমসলা ও উপাদান গুলোর যথাযথ প্রয়োগ ও যথোপযুক্ত মান ছিল কিনা! সে জন্য যতটুকু পারা যায়, সে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যেমন, বালি কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল? ইটের প্রকার কেমন ছিল? সিমেন্ট কোন কোম্পানির এবং কারা সরবরাহ করেছিল? রডের প্রকৃতি কেমন ও কোন কোম্পানির? কারা সরবরাহ কারী? দলীলের জন্য পারত পক্ষে তাদের কোম্পানির বিলের কপি ও ঠিকানা সংগ্রহ করে রাখা। ভবন তৈরির আধুনিক নীতিমালা অনুযায়ী যে সকল মালামাল ভবনের কাজের স্থলে আসবে তাদের ছবি তুলে রাখতে হয়। শুধু মালামালের ছবি দিলে হবেনা, সাথে কাজ চলমান অবস্থায় ভবনের ছবিও তুলতে হয়। যাতে সন্দেহ মুক্ত হওয়া যায় যে, ছবিটা ভবনের কাজ চলাকালীন সময়ে সরবরাহ কৃত মাল সামানের ডিজিটাল ছবি। লোহার কিয়দংশ নাম দেখা যায় এমন কনক্রিটের দেওয়ালের ক্লোজআপ ছবি, ইটের লোগো ও গাঁথুনির ছবি, সিমেন্টের প্রলেপের ছবি। যিনি ছবি তুলেছেন তাঁর এবং উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ারের দস্তখত নিতে হয়। সেই ছবি গুলো ডেভলোপার কোম্পানি দ্বারা সত্যায়িত হতে হয়। ক্যামেরাতে ছবি তোলার সময় ও তারিখ এডজাষ্ট থাকতে হয়। তাহলে অনেক ছবি তুলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে সাইন সিল দলীলের জন্য রাখতে হয়। দরজা-জানালার গ্রিল ও কাঠের কাজের নির্মাণকারী কারা। একবছর পরে দরজার কাঠে ‘ঘুণ’ ধরলে কাকে ধরা হবে? এসব খুঁটিনাটি সতর্কতা হয়ত আমাদের দেশে এখনও চালু হয়নি। তবুও প্রশ্ন করলে ডেভলোপার কোম্পানিগুলো বুঝতে পারবে, ক্রেতা সতর্ক হচ্ছে তাদের খুশী করতে হলে, আরো বেশী তত্ত্ব ও তথ্য রাখতে হবে। এতে তাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং স্বচ্ছতা নিরূপণের জন্য তারা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে। যারা ফ্লাটের কন্ট্রাক করে ফেলেছেন তাদের দুঃচিন্তা করার কোন কারণ নাই, যারা ভবিষ্যতে কন্ট্রাক করবে তারা এসব চাইলে কর্তৃপক্ষের পূর্ব হতে সতর্ক হবার সুযোগ মিলবে। কেননা ডেভলোপার কোম্পানি গুলো চায় ক্রেতারা ভাল জিনিষটি আমাদের নিকট থেকে পেয়ে যাক। ৫. Structural Drawing সংগ্রহ করে ভবনের উচ্চতা বর্ণনা করে বিম, কলাম, মাটি খননের গভীরতা, ফাইলিং, রডের সাইজ, ধরন ইত্যাদি পুনঃ বিশ্লেষণের জন্য কোন একজন দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে দেখান। তিনি বলে দিতে পারবেন নির্মাণকাজে কোন চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে কিনা। স্টিল ড্রয়িং, বিম ও কলামের আকৃতি দেখে তিনি বলে দিতে পারবেন প্রয়োজনের তুলনায় এসবের গঠন ও প্রকৃতি দুর্বল কিনা? বাংলাদেশ যেহেতু একটি ভিন্ন চরিত্রের দেশ! তাই সাহায্য নেওয়া সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে নকশা দেবার সময়; নকশা থেকে ডেভলোপার কোম্পানি, কনসালটেন্ট, স্থান, টেলিফোন সহ সমুদয় তথ্য গোপন করা বাঞ্ছনীয়। কেননা তিনিও ডেভলোপারের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়ে তাদের নিকট থেকে অন্যায় সুবিধা নিতে পারে কিংবা তিনিও তাদের লোক হয়ে যেতে পারেন! এসব তথ্য গোপন না করে বিস্তারিত প্রকাশ করার মাধ্যমে ক্রেতার ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই। হয়ত বলবেন! বুদ্ধি ধরতে গিয়ে ৫ থেকে ১০ টাকার খরচ বাড়ানো হল? এর সোজা উত্তর হল, ৪০ লক্ষ টাকার বাড়িতে উঠার জন্য ৫ হাজার টাকার ঝুঁকিটা তেমন কিছু না, কেননা এই ভবনে আপনি, আপনার সন্তান, তাদের সন্তান বেড়ে উঠবে ও বেঁচে থাকবে। ৬. আপনি যে এলাকায় ফ্লাট কিনতে চাচ্ছেন, সে এলাকার সরকারি বিধিবিধান কি তা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে জেনে নিন। সে এলাকায় সর্বোচ্চ কত তলা পর্যন্ত ভবন করার অনুমোদন আছে। এলাকায় বসবাসের জন্য আদৌ কোন অনুমোদন আছে কিনা? কিংবা তলে তলে এলাকাটি সরকারী খাতায় শিল্প জোন হিসেবে বিবেচিত কিনা? আপনার অনুমোদিত ভবন থেকে সীমানা পর্যন্ত কতটুকু ছাড় দিতে হবে? অতীতে সবচেয়ে বড় বন্যার সময় এই এলাকায় পানির উচ্চতা কত ছিল এবং জলাবদ্ধতা হয় কিনা? হলে কতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল? আরো জানতে হবে আপনার ভবনের মাটির উচ্চতা কত হওয়াটা বিধিসম্মত? এখানে উচ্চতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সরকারী হিসেবে উচ্চতা কত হতে হবে তার বিধি আছে। আমাদের দেশে এসব বিষয় গুলোকে ফাঁকির মাধ্যমে এড়িয়ে গিয়ে ভবন অনুমোদনের বহু নজির আছে। উপরের ছয়টি পর্যায়ে বাহিরের তথ্য নিয়ে লিখা হয়েছে, নিচের সমস্যা গুলো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করা হল; ৭. আপনি যে ফ্লোরে থাকতে চান, তার উপরের ফ্লাট ও নীচের ফ্লাট গুলো একই কিনা দেখুন। যদি একই হয় তাহলে সবার সমস্যা ও সম্ভাবনা একই হবে। এই ক্ষেত্রে প্রথমে নিজেদের গোসল খানা এবং টয়লেট টি দেখুন এবং অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই ঘটবে এমন একটি তিক্ত সমস্যা আজই সমাধান করুন। দেখুন, আপনার টয়লেটের পাইপ যদি ভেঙ্গে যায়, কিংবা ফ্লোরে পানি একাকার হয়। তাহলে নীচের তলার মানুষদের সমস্যা না করে নিজের টয়লেটের সমস্যা নিজের কক্ষে সমাধান হচ্ছে কিনা? যদি সমাধান হয় তাহলে উত্তম। যদি না হয়, তাহলে মনে রাখবেন যেদিন এই সমস্যা দেখা দিবে, সেদিন থেকে নিচের তলার বাসিন্দাদের সাথে স্থায়ী শত্রুতার সূত্রপাত হবে। কেননা এই সমস্যা একবার দেখা দিলে স্থায়ী সমাধান হয়না। মোদ্দা কথা হল ফ্লাটের সমস্যাটি নিচের কারো সমস্যা না করে নিজের ফ্লাটে বসে সমাধান হয় কিনা? হলে এটাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাল দিক বিবেচনা করুন। আর যদি উপরের ফ্লোর আর নিচের ফ্লোর ভিন্ন হয়! ধরুন আপনার কক্ষটি তিন বেড রুম, ঠিক উপরের কক্ষ গুলো দুই বেড রুম বিশিষ্ট। তাহলে দেখে নিন, আপনার উপরের ফ্লোরের গোসল খানা, রান্না ঘর সহ পানির সম্পর্ক আছে এমন কক্ষগুলো আপনার বেড রুমের ঠিক কোন স্থানে? যদি উপরে হয় কিংবা পানির লাইন ক্রস হয়, তাহলে জীবনে কোন একদিন তাদের কক্ষের নিঃসরিত পানি আপনার বেডরুমে আসতে পারে। আর আপনি যদি সেই উপরের ফ্লোরের মালিক হন, তাহলে নীচের ফ্লোরের বাসিন্দাদের অনুরোধের বেড়াজালে আবদ্ধ হতে হবে। কেননা সমস্যা নীচের ফ্লোরের আর গোসল খানা ভাঙ্গতে হবে আপনার টি! মূলত এসব ব্যপার গুলো ইঞ্জিনিয়ার মাথায় রেখেই ভবন তৈরি করে। তবে কারো কপাল খারাপ হলে উল্টো পাল্টা কিছু একটা হয়ে যেতে পারে, তাই সতর্ক হলেই কল্যাণ। ৮. ভবনে আগুন লাগলে পালানোর রাস্তা আছে কিনা? ভবনের মাঝখানে যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়, বিপদের সময় সেটা দিয়ে পালানো যাবে! একটি কথা মনে রাখবেন, আগুন ব্যাপক ভাবে জ্বলে উঠার বহু আগেই মানুষ মৃত্যু বরণ করে শুধুমাত্র ধুয়ার কারণে! তাই সিঁড়ির সামনে কিংবা লাগোয়া কক্ষে যদি আগুন লাগে তখন অনেকেই পালাতে পারবে না এবং ধুয়োর কুন্ডুলীকে আটকা পড়ে মারা যাবে। সেই অবস্থায় বিকল্প সিঁড়ি আছে কিনা দেখতে হবে। বাংলাদেশ বৃষ্টি বাদলের দেশ, ব্যালকনিতে বৃষ্টির পানি জমবে, সেই পানি নিষ্কাসনের জন্য ট্র্যাপ রাখা হয়েছে কিনা? ফ্লাট বুঝে নেবার আগে টয়লেট, রান্নাঘর, ব্যালকনিতে এক বালতি করে পানি ঢেলে দেখতে হবে, সকল পানি ফ্লোরের ঢালু বেয়ে ফ্লোর ট্র্যাপে পড়ছে কিনা? সুবিধা অসুবিধা ঘটনাস্থলেই বুঝতে পারবেন। আপনি যে তলায় বসবাস করবেন ইলেকট্রিক্যাল কক্ষটি সেই তলায় থাকাটা আবশ্যক। মেইন ইলেকট্রিক্যাল রুমে গিয়ে আপনার ভবনের কানেকশনটি কোথায় লাগানো আছে, দেখে নেওয়া উচিত। ভূমিকম্প কিংবা অন্য কারণে ফ্লাটের মূল ইলেকট্রিক্যালের তার ছিঁড়ে গেলে, সেটার রাস্তা উদ্ধার করা মুশকিল হবে। সে সময় এস বিল্ড নকশার সাহায্য নিতে হবে। নিজের ইচ্ছামত করিডোর দিয়ে তার টানতে গেলে, অ-সৌন্দর্য ও অনিরাপদের জন্য অন্যরা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ভবনে ময়লা ফেলার জন্য Garbage Hole আছে কিনা। সকল ভবনে এটা থাকেনা, থাকলে বাড়তি সুবিধা। কেননা যে কোন তলা থেকে অপ্রয়োজনীয় ময়লা এই গর্ত দিয়ে নীচে ফেলা যায়। ৯. ভবনে টেলিফোন সংযোগের ব্যবস্থা নিচের তলা থেকে হলে নিরাপদ ও সুন্দর হয়। ফলে বাহিরের টানা তারের কারণে ভবনের সৌন্দর্য বিনষ্ট ও পাখি বসার সুযোগ থাকবে না। ভবনের ছাদে অবশ্যই সেন্ট্রাল ডিস এন্টেনার সুযোগ এবং প্রতি তলায় স্প্লিটার কানেকশন থাকা উচিত। এতে অন্যরা নিজেদের ইচ্ছামত ডিস বসানো কিংবা তার টানার সুযোগ কমে যায়। বজ্রপাত আঘাত হানলে সেটি মাটিতে চলে যেতে হবে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পিতলের থাম বসানোর মাধ্যমে পুরো ভবনটির Earth Protected করা হয়েছে কিনা? নতুবা জীবনের ঝুঁকি ছাড়াও ভবনের লাইট, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল সহ সমুদয় ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মুহূর্তে নষ্ট হয়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়াবে। ভবন যদি বড় হয়, তাহলে কক্ষের ভিতরে প্রয়োজন মত মোবাইল সিগন্যাল পাওয়া যায় কিনা। নতুবা মজবুত সিগন্যালের জন্য প্রয়োজনীয় Wireless Access সরঞ্জাম বসাতে হবে, কেননা এই সমস্যাটি সবার জন্য সমান। ভবনের নিচে কোন মেহমান আসলে তার সাথে কথা বলার জন্য ভিডিও কিংবা অডিও যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে কিনা। না থাকলেও ভবিষ্যতে করতে পারার জন্য সুযোগ রেখেছে কিনা? ভবনে আগুন লাগলে মুহূর্তে সবাইকে সতর্ক করার জন্য Fire Alarm ব্যবস্থা আছে কিনা? থাকলে বিস্তারিত জেনে নেওয়া। এ সকল ইলেকট্রনিক্স জিনিষ কারা সরবরাহ করেছে এবং কত বছরের গ্যারান্টি কিংবা ওয়ারেন্টটি দিয়েছে, এসকল তথ্য জানতে হবে। তাদের সাথে কোন মজবুত চুক্তি থাকলে, চুক্তির বিষয়টি কারা দেখাশোনা করবে। কেননা বিপদের দিনে তারা যদি সার্ভিস না দেয় তাহলে সবার ভোগান্তি হবে। ১০. বাসায় উঠার পরে প্রতি মাসে একবার হলেও একটি পরিকল্পিত পারিবারিক ইমার্জেন্সী সার্ভিস রপ্ত করতে হবে। মনে করুন ভবনে আগুন লেগেছে, সেটা মনে করে পরিবারের সাইকে নিয়ে পালালেন। সেজন্য কম সময়ে আহত না হয়ে সবাইকে নিরাপদে নামতে হবে। তাই সবাইকে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পড়ুন এবং দেখুন কত সময় লেগেছে। একবার এক সিঁড়ি দিয়ে নামুন অতঃপর ঘরে বসে দেখুন কি কি ভুল করা হয়েছে। যাবার সময় দরজা জানালা বন্ধ করতে পেরেছিলেন কিনা। কেননা আগুনের ভয়ে পালানোর সময় আতঙ্কে দরজা জানালা খোলা রেখেই সবাই পালায়, এতে ঘরে অক্সিজেন ঢুকে পড়ে, ফলে আগুন তাড়াতাড়ি বিস্তারের সুযোগ পায়। এই ধরনের বিপদে ৪০ কেজি ওজনের জিনিষ নিয়ে পালানো সম্ভব নয়। তারপরও হালকা অথচ অতি জরুরী জিনিষ বাঁচানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন, পাসপোর্ট, চেক বই, বিভিন্ন দলিল, অলঙ্কারের ছোট্ট প্যাকেট ইত্যাদি। নিজে এবং গিন্নী পরিকল্পনা করে এসব জিনিষ এমন জায়গায় নিরাপদে রাখুন যাতে ত্রিশ সেকেন্ড সময় ব্যবহার করে পরিবারের প্রাণ নিয়ে ভাগতে পারেন। সেজন্য রিহার্সাল প্রয়োজন। জীবনে প্রতি বছর ঘরে আগুন লাগে না, তবে যেদিন লাগবে সেদিন বুদ্ধি কাজ করবে না। তাই এসব মাথায় রাখতে হবে। মূলত এই রিহার্সাল এককভাবে না করে পুরো ভবনের সবাই করলে সুফল পাওয়া যাবে। তখন বুঝা যাবে একসাথে এত মানুষ নামতে গেলে সিঁড়িতে কেমন জট তৈরি হয়। ওহ হো, মূল কথাই বলা হয়নি! কোন অবস্থাতেই সিঁড়িতে মালামাল রাখা যাবেনা, এমনকি এটাকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রামের স্থান বানানো ঠিক নয়। মালামালের লোভ করে পালাতে দেরী করলে আহত হয়ে কিংবা জীবন দিয়ে চরম খেসারত গুনতে হবে। ১১. ভাড়া বাসায় থাকা আর নিজের টাকায় কেনা ফ্লাটে থাকার মাঝে বিস্তর ব্যবধান আছে। ভাড়া বাসায় মালিক থাকে একজন, তাই একজনের সিদ্ধান্তে সকল সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটানো সম্ভব। আর ফ্লাট ভবনে মালিক থাকে অনেক জন। এখানে সমস্যার আশু সমাধান তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। মানুষ আয় রোজগারের সুখের দিনে ফ্লাট কিনে, আর যখন ফ্লাটে থাকতে যায় তখন তার আয়-রোজগার আগের মত থাকেনা। সে জন্য যে জিনিষটি মাথায় রাখতে হবে সেটা হল বিভিন্ন জিনিষের সার্ভিস খরচ। প্রথম দশ বছর ভবনের চামড়া উঠবে না, প্রথম পাঁচ বছর লিপ্টের কোন সমস্যা থাকবে না, প্রথম তিন বছর ভবনের রঙ্গের কোন সমস্যা থাকবে না, প্রথম দুই বছর জেনারেটরের কোন সমস্যা থাকবে না, প্রথম এক বছর পানির পাম্প মেশিনের কোন সমস্যা থাকবে না। প্রথম ছয় মাস ঘরের লাইট, পানি নিষ্কাশনে কোন সমস্যা থাকবে না। শুরুর প্রথম মাস দারোয়ান, সুইপার, পানির বিল, বিদ্যুৎ বিলের ঝামেলা থাকবেনা। তবে এসব খরচ দিনে দিনে আসবে এবং তা বাড়তে থাকবে। সে সব খরচের কিছু ব্যক্তিগত কিছু সমষ্টিগত। তবে ফ্লাট ভবনের বেশীর ভাগ খরচ সমষ্টিগত। দারোয়ান, সুইপার, রং করা, পাম্প মেশিন ঠিক করা, ভবনে প্রয়োজনীয় সার্ভিস করা, লিপ্টের ম্যানট্যানেন্স, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির সংরক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে একটি খরচ আসবেই। সেই খরচের কথা খেয়াল রাখতে হবে। ভবন যত আধুনিক হবে, খরচও তত বেশী হবে। ২০ জন ফ্লাটের মালিক থেকে ১৮ জন টাকা দিল দুই জন দিতে পারল না। সে জন্য কাজ আটকে থাকবে। তখন তাকে সেই ১৮ জনের প্রশ্নের দৌড়ের উপর থাকতে হবে। সুতরাং ফ্লাট নেবার সময় এই কথাটি মাথায় রাখলে পরে বিপদে পড়তে হবেনা। নিজে নিজে হিসেব করে দেখতে হবে, ৪০ লাখ টাকার ভবনে যদি মাসিক সার্ভিস চার্জ ১০ হাজার টাকা আসে। তাহলে সে ধরনের একটি ফ্লাটে ভাড়া থাকলে কত দিতে হবে। আর ৪০ লাখ টাকা ব্যাংকে ফেলে রাখলে জাকাত দেবার পরে কত আসে? ১২. অনেকগুলো পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আলোকে এক ডজন পরামর্শ উপস্থাপন করেছি। জানি আমার পয়েন্টের সাথে হুবহু মিলিয়ে শতভাগ পরিপূর্ণ ফ্লাট জোগাড় করা কঠিন। এমনকি আমি নিজেও কিনতে গিয়ে ঠকে যেতে পারি। তারপরও অনেক সচেতন মানুষের জন্য লিখাটি হয়ত উপকারে আসবে, আমিও কিছুটা কল্যাণের ভাগীদার হতে পারব। একটি কথা মনে রাখতে হবে, নিজের মনের মত করে আরেকজন মানুষ কোনদিন পাওয়া যায়না। সে ক্ষেত্রে নিজেকে ত্যাগ করে অন্য জন যাতে ভালবাসে, সে ভাবে নিজেকে গড়তে পারলে দুনিয়াতে তার কোন সমস্যা হয় না। ফ্লাট বাড়িতে সবাই ধনী, কেউ কারো কথার তলে থাকার মানুষ নন। কারো মর্যাদাহানি, অসম্মান, পরিবারের নিরাপত্তা হীনতার ব্যাঘাত হলে সমস্যা জটিল হতে বাধ্য। কেননা এটা ভাড়া বাসা নয় যে, পরের মাসে অন্যত্র আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়ে চলে গেলেন। তাই একগুঁয়েমি স্বভাব, গর্ব-ভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব, অন্যকে তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা থাকলে ফ্লাট বাড়িতে সুখের বদলে দুঃখের বন্যাই বেশী বইবে। সে ধরনের ব্যক্তির জন্য ভাড়া বাসাই উত্তম। বাংলাদেশে প্রচুর মান সম্মত ডেভলোপার কোম্পানি আছে, তাদের অনেকেই উত্তম নাগরিক সুবিধা দিয়ে ক্রেতা ধরতে প্রতিযোগিতা করে। তাদের নিকট থেকে যাচাই করে একটি ফ্লাটের গর্বিত মালিক হোন। সাইন বোর্ড আর চটকদার টিভি বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হবেনা না। ডেভলোপার কোম্পানির যোগ্যতা দক্ষতার সাথে যে জিনিষটাকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে তা হল সততা আর ইমানদারীতার সুনামকে। একজন অবিশ্বস্ত ডাক্তার হয়ত একজন রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তবে একজন অবিশ্বস্ত প্রকৌশলী একসাথে হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। লেখক আমিরাত প্রবাসী। tipu1900@yahoo.com (লেখক দীর্ঘ ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে আধুনিক প্রযুক্তির ভবনের ইলেক্ট্রো ম্যাকানিক্যাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত) |
Friday, February 15, 2013
ফ্লাট কেনায় এক ডজন পরামর্শ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment