Friday, February 15, 2013

শাহবাগের মোমবাতিতে একাত্তরের চেতনার অগি্নস্ফুলিঙ্গ

শাহবাগের মোমবাতিতে একাত্তরের চেতনার অগি্নস্ফুলিঙ্গ

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী


নিন্দা এবং গালি শুনেও যে এতটা আনন্দ পাওয়া যায়, তা জীবনে আগে কখনও এমন করে উপলব্ধি করিনি। ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়ে রাজাকার কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সম্পর্কে ঢাকার একটি দৈনিকে আমি লিখেছি, ট্রাইব্যুনাল জনমতের চাপে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন না। আবার এই দণ্ড না দেওয়ার জন্য কোনো অপশক্তির হুমকির কাছেও মাথানত করতে পারেন না। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারেও ন্যায়বিচারে অটল থাকবেন এবং বিচারের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখবেন_ এটাই আমাদের কাম্য। এই বক্তব্য আমার সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের পছন্দ হয়নি। তারা মৃত্যুদণ্ড চান।

লেখাটি ছাপা হয়েছে গত বুধবার (৬ ফেব্রুয়ারি)। সেদিন থেকে অদ্যাবধি অনূ্যন দশটি টেলিফোন কল পেয়েছি। নিজের দেশ এবং বিদেশ থেকেও। এই দশটি টেলিফোন কলের নয়টিই হচ্ছে আমার লেখার নিন্দা ও সমালোচনা। আমি কেন কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড দাবি করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের সমালোচনা করিনি_ তা নিয়ে প্রশ্ন। কেউ নরম ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কেউ গরম ভাষায়।

কেবল একটি টেলিফোন-আলাপ হচ্ছে ব্যতিক্রম। সেই টেলিফোনটি আমিই করেছিলাম যে দৈনিকে গত বুধবার আমার কলামটি প্রকাশিত হয়েছে, তার সম্পাদককে। তিনি দেশের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক। তার মতামতকে আমি সম্মান করি। তিনি বললেন, 'আপনি যা লিখেছেন তা যুক্তিযুক্ত। সাহসের সঙ্গে বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। তবে আপনার লেখাটি পাবলিক সেন্টিমেন্টের পক্ষে যায়নি। ফলে আপনি আপনার পাঠকদের কাছেও সমালোচিত হচ্ছেন।'

আমি এই প্রবীণ সম্পাদক বন্ধুকে যা বলিনি তা হচ্ছে, এই সমালোচনা বা গালিনিন্দা শুনে কোনো রাগ হচ্ছে না। বিস্ময়করভাবে আমি আনন্দ লাভ করছি। কারণ, কাদের মোল্লার মতো মানবতার জঘন্য শত্রুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হোক, তা আমিও চাইনি_ তা নয়। তবে সেই সঙ্গে এ-ও চেয়েছি, ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা যেন বজায় থাকে, যা বিশ্বের অনেক দেশের দাবি। তারা যেন জনমতের চাপে বা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের হুমকির কাছে নতজানু হয়ে রায় না দেন।

ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়টি বিতর্কিত এবং দেশের বিপুল বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সমর্থন না পেলেও এই রায়ের দুটি বড় প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। প্রথম, এই রায় প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা দ্বারা ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত নয়। দ্বিতীয়, এই রায় দেশের নিদ্রিত জনমতকে এমনভাবে জাগ্রত করেছে যে, তা রাজপথে জামায়াতের জনসমর্থনহীন ক্যাডারভিত্তিক তাণ্ডব সৃষ্টির চেষ্টা প্রায় ব্যর্থ করে দিতে যাচ্ছে এবং সারাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এমন উত্তাল গণতরঙ্গ সৃষ্টি করেছে যে, যা একাত্তরের ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঢাকার শাহবাগে মোমবাতি জ্বালিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে যে জনসমুদ্র তৈরি হয়েছে, তাকে অনেকে কায়রোর তাহরির স্কয়ারের জনতার ঢলের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আমি একজন নগণ্য ব্যক্তি হয়েও এই গণজোয়ারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। এই গণজোয়ার তো শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়দান শুরু। অর্থাৎ বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হতেই সারাদেশ উল্লাসমুখর হয়েছে এবং তার পাশাপাশি জামায়াতিরা রাস্তায় নেমে অতর্কিতে হামলা ও মানুষসহ বাস, গাড়ি পোড়াতে শুরু করে। তাদের এই রণকৌশলের সামনে পুলিশকেও অনেক সময় অসহায় মনে হয়েছে। তারা মার খেয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আমার একাধিক কলামে লিখেছি, কেবল পুলিশ বা র‌্যাব দিয়ে এই ট্রেনিংপ্রাপ্ত, সশস্ত্র গুণ্ডামি বন্ধ করা যাবে না। সরকারকে কঠোর হতে হবে, শক্তি বাড়াতে হবে এবং সারাদেশে জামায়াতের ফ্যাসিবাদী তাণ্ডবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই গুণ্ডামির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠলেই সরকারের কার্যক্রমও সফল হবে। কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষিত হওয়ার পর তার প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে যে গণপ্রতিবাদ জাগ্রত হয়েছে, তাতে স্বাধীনতা এবং মানবতার শত্রুশিবির এখন কম্পিত। দলমত নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষ এই গণপ্রতিরোধে শামিল হয়েছে। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী দল ঢাকার শাহবাগের অথবা ঢাকার তাহরির স্কয়ারের গণসমাবেশে সমর্থন জানিয়েছে; একমাত্র বিএনপি এবং ছাত্রদলসহ তার তথাকথিত জাতীয়তাবাদী অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলো ছাড়া।

সরকার জামায়াতিদের এবং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের দুর্বৃত্তপনা ও গুণ্ডামি প্রতিরোধে আরও কঠোর হয়েছে এবং দেশে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। ফলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জামায়াতিদের বর্তমান মূষিকনীতি যে ব্যর্থ হবে এবং '৭১-এর পরাজিত শত্রুরা তাদের নতুন দোসরসহ আবারও পরাজিত হবে, এমনকি শাহবাগের গণজোয়ার অব্যাহত থাকলে এই দুর্বৃত্তরা দেশের মাটি থেকে স্থায়ীভাবে নির্মূল হবে_ এই আশা পোষণ করা চলে।

দেশে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। সরকারকেও মানবতার শত্রু এবং গণশত্রুদের শাস্তিদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং আরও কঠোর হতে হবে। দেশের মানুষের কাছে সরকারকে এই বিশ্বাস সন্দেহাতীত করে তুলতে হবে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও প্রাপ্য শাস্তিদানে তারা কোনো প্রকার দুর্বলতা বা আপসের মনোভাব দেখাবে না। ঢাকায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় দেশের মানুষ যে ক্ষুব্ধ হয়েছে, তার প্রধান কারণ দুটি। তারা মনে করে, গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও দণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তথাপি এর পেছনে সরকারের হয়তো দুর্বলতা ও আপসমুখী ভাব রয়েছে।
এই সন্দেহটি জনমনে আরও ছড়িয়েছে জামায়াত ও বিএনপির প্রচারবিদরা। তারা ভেবেছিল, কাদের মোল্লার মামলার রায়কে সরকারের ও ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতা, সরকারের আপস করার গোপন চেষ্টা, এমনকি বিচারে জামায়াতকে বড় কনসেশন দিয়ে গোপনে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আঁতাত করার প্রয়াস ইত্যাদি কথা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে সরকার, ট্রাইব্যুনাল ও বিচারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করবে এবং তাদের মনোবল ধ্বংস করবে। সেই সুযোগে জামায়াতি মূষিকেরা সর্বত্র অরাজকতা সৃষ্টি করে প্রশাসন অচল করবে এবং বিচার ভণ্ডুল করে দেবে।

জামায়াত-বিএনপির এই চালাকি ও অপপ্রচার তাদের জন্যই বুমেরাং হয়েছে। বিচারে কাদের মোল্লার লঘু দণ্ড হয়েছে এবং সরকার ও ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতায় সাঈদী, গোলাম আযম, নিজামী প্রমুখ পালের গোদার শাস্তি আরও লঘু হতে পারে_ এই সন্দেহ জনমনে দেখা দিতেই তারা আকস্মিকভাবে সামুদ্রিক ঝড়ের মতো জেগে উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের গুরু পাপে লঘু দণ্ড দানের অভিযোগে একাত্তরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। জামায়াত এখনও এখানে-ওখানে মাথা তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের অবস্থা ভীত পার্বত্য মূষিকের মতো। বিএনপির অবস্থা মহারাজ ত্রিশঙ্কুর মতো। খালেদা জিয়া তো 'ওয়াশিংটন টাইমস' পত্রিকায় তার ঘোস্ট রাইটারের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশের হঠকারিতার বিপাক থেকেই এখনও মুক্ত হতে পারেননি; তিনি দোসর জামায়াতিদের সাহায্যদানে এগুবেন কী করে? ত্রুক্রদ্ধ জনমতের ভয়ে তারা ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করতে পারছেন না। তবে নানা ফোকর খুঁজছেন_ কীভাবে কৌশলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো যায়।

তবে এসব কৌশল বর্তমান জনজোয়ারের মুখে কোনো কাজ দেবে মনে হয় না। বিচারের দ্বিতীয় রায়টি সম্পর্কে জামায়াত ও বিএনপি জনমনে যে সন্দেহটি জাগাতে চেয়েছে; তা কিছুটা জেগেছে বৈকি, কিন্তু তা বুমেরাং হয়েছে জামায়াত-বিএনপির জুটির বিরুদ্ধেই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে কম শাস্তি নয়। কিন্তু জনগণের সন্দেহ, '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা যদি সরকার বা ট্রাইব্যুনালের কোনো প্রকার দুর্বলতার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পায়, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে বা অন্য কোনোভাবে যদি জামায়াত ও বিএনপি ক্ষমতায় যায়, তাহলে এই মানবতার জঘন্য শত্রুদের শাস্তি তারা মওকুফ করে দেবে এবং আগের মতো স্বাধীনতার শত্রুদের কারও কারও গাড়িতে বাংলাদেশের মন্ত্রিত্বের পতাকা উড়বে। বর্তমান হাসিনা সরকারের যত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকুক, এই সরকার ক্ষমতা হারালে এবং জামায়াত-বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে দেশে ২০০১ সালের চেয়েও কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা কল্পনা করে আওয়ামী লীগের অনেক বড় সমালোচকও এখন শিউরে ওঠেন।

এই সন্দেহ ও এই ভীতিই দেশের মানুষকে জামায়াত ও বিএনপির প্রত্যাশা অনুযায়ী মনোবলহারা, নিষ্ক্রিয় ও হতাশ জনগোষ্ঠীতে পরিণত না করে দীর্ঘকাল পর একাত্তরের চেতনায় জাগ্রত ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। শুধু ঢাকার শাহবাগে নয়, সারাদেশে জনসমুদ্র গর্জে উঠেছে। লাখ লাখ মোমবাতি একাত্তরের চেতনায় আভা ছড়াচ্ছে লাখো মনে। এই জনক্রোধ ও জনপ্রতিরোধ বর্তমান সরকার বা যুদ্ধাপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে নয়। এই জনক্রোধ জেগেছে মানবতার শত্রুরা গুরু পাপে লঘু দণ্ড পাবে, এমনকি এখন কারাদণ্ড পেলেও জামায়াত ও বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে অপরাধীদের জামাই আদরে ছেড়ে দেবে_ এই আশঙ্কায়।
আওয়ামী লীগ সরকার ও ট্রাইব্যুনালের জন্য এই জনক্রোধ ও জনপ্রতিরোধ এক বিশাল সহায়ক শক্তি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যাতে দণ্ড দেওয়া না হয় সেজন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও ট্রাইব্যুনালের ওপর বিদেশের কিছু শক্তিশালী মহল ও সরকারের বিরাট চাপ আছে। এই চাপ মোকাবেলা করার জন্য সরকার ও ট্রাইব্যুনাল_ দুইয়ের দরকার দেশের মানুষের অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন। শাহবাগের উৎসমুখ থেকে সারাদেশে প্রসারিত জনজোয়ার সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার অনুষ্ঠানে অটল থাকার ব্যাপারে সাহস ও শক্তি জোগাবে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার ও শাস্তিদানের ব্যাপারে এবং দেশবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে হাসিনা সরকারের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা আন্তরিকতার অভাব আছে বা ট্রাইব্যুনালের মধ্যে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার কোনো অভাব আছে_ আমি তা মনে করি না। যেটা থাকতে পারে সেটা হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের শক্তিশালী চাপ ও চক্রান্তের মুখে কিছু দুর্বলতা। পেছনে দেশের মানুষের সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সমর্থন থাকলে সরকার অবশ্যই এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। '৭১ সালেও সারা বাংলাদেশের গণরায় যদি বঙ্গবন্ধু না পেতেন এবং গোটা বাঙালি জাতি তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ না হতো, তাহলে তিনিও আমেরিকার মতো একটি সুপার পাওয়ারের বিরোধিতার মুখে একটি শক্তিশালী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র যুদ্ধে নামতে সাহস করতেন কি?

শাহবাগের উৎসমুখ থেকে প্রসারিত সারাদেশের জনজোয়ার হাসিনা সরকারের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো দুর্বলতা বা দোদুল্যমানতার সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা দূর করবে এবং ট্রাইব্যুনালকেও নৈতিক সাহস ও ন্যায়বিচারে অটল থাকার মনোবল জোগাবে। সুতরাং একাত্তরের চেতনায় উদ্দীপ্ত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির এই গণউপপ্লবকে আমাদের অভিনন্দন জানাতে হয়।
আবারও লিখছি, ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ না দিয়ে কোনো অন্যায় করেছেন বা দুর্বলতা দেখিয়েছেন বলে আমি মনে করি না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কোনো লঘু দণ্ড নয়। আর জনমতের চাপে সব অভিযুক্তকেই চরম দণ্ড দিতে হবে_ এটাও কোনো কাজের কথা নয়। তাহলে আর বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা কেন?

যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধগুলো যখন সারাদেশের মানুষ জানে এবং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড চায়, তখন সরকার সেই দণ্ড দিয়ে দিলেই তো পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ন্যায়বিচার এবং আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা বলে একটা কথা আছে। বাংলাদেশকে তা মেনে চলতে হবে।

তবে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে একটি পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখা উচিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ের নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের মতোই বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের অপরাধ সর্বজনবিদিত। ন্যুরেমবার্গ আদালতের বিচারে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা সবাইকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশেও শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত '৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের মক্ ট্রায়ালের জন্য যে গণআদালত গঠিত হয়েছিল, তার বিচারের রায়ে গোলাম আযমসহ অধিকাংশ অভিযুক্তের প্রাণদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তখনকার এই আদালতের রায়ের কোনো আইনগত ভিত্তি না থাকুক, একটা শক্ত নৈতিক ভিত্তি ছিল। বর্তমান ট্রাইব্যুনালের উচিত, সেই আদালতের রায়ের নৈতিক ভিত্তিটা উপেক্ষা না করা।

ঢাকার শাহবাগ আন্দোলনে আরেকটা সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে। সেটি হলো, দেশের তরুণ প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা ভোলেনি। বিএনপির ইতিহাস-বিকৃতি তাদের পথভ্রষ্ট করেনি। তারা একাত্তরের স্বদেশদ্রোহী ঘাতকদের ক্ষমা করেনি। কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষিত হতেই দেশব্যাপী যে উত্তাল জলতরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে, তার মূল উদ্যোক্তা তরুণ সমাজ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে এই তরুণ সমাজ এতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আওয়ামী লীগ সরকারও এই বিচারে দোদুল্যমানতা দেখালে রেহাই পাবে না।

আরও একটা ব্যাপারে আমি আনন্দিত হয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে দেশে যে জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, এই জোয়ার সৃষ্টিতে বাংলাদেশের মূলধারায় ছাত্রলীগের একটা বড় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। আসলে এটাই ছাত্রলীগের ভূমিকা এবং তাদের ঐতিহ্য। মাঝখানে টেন্ডারবাজি, লাইসেন্সবাজি, দলীয় কোন্দল, সংঘাত, হত্যা, রক্তপাত ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যে কালিমা লেপে দিয়েছে। আবার আন্দোলনের মাঠে ফিরে আসাই এই কালিমা ও কলঙ্ক মোচনের একমাত্র পথ। শাহবাগের জনজোয়ারে সুস্থ ও সঠিক ভূমিকা রাখার পথে ছাত্রলীগ আর বিপথগামী হবে না এবং বিপথগামীদের দল থেকে নির্মূল করবে_ এটাই আমার কামনা।

(সুত্র, সমকাল, ০৯/০২/২০১৩)
http://www.sonarbangladesh.com/writer/AbdulGaffarChowdhury

No comments:

Post a Comment