Friday, February 15, 2013

ও আলোর পথযাত্রী, ...এখানে থেমো না

ও আলোর পথযাত্রী, ...এখানে থেমো না

এবিএম মুসা

গত বুধবার ভোরবেলা প্রথম যেসব পত্রিকা পেলাম, সেগুলোর সব কটির লিড নিউজ তথা প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন’। অতিসাধারণ চার কলামের শিরোনাম, যেকোনো হত্যা মামলার রায়ের খবরের সঙ্গে কোনো ফারাক খুঁজে পেলাম না। খুনি-ধর্ষকের যাবজ্জীবন একটু লঘু শাস্তি মনে হলো, এটুকুই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। পরদিনের প্রতিটি পত্রিকায় কাদের মোল্লার গুরুপাপে লঘুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া পেলাম। তারুণ্যের প্রতিবাদের আকাশবিদারী প্রতিধ্বনি আমাকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। তাৎক্ষণিকভাবে হূদয় উদ্বেলিত হলো একটি মহাজাগরণের আগমনের প্রত্যাশায়। শাহবাগ চত্বরে সেই জাগরণের সূর্যোদয় দেখে মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলাম রবিঠাকুরের অনবদ্য একটি চরণ: ‘আজি প্রাতে সূর্য্য ওঠা সফল হলো কার’।

অতঃপর পরবর্তী দিনগুলোতে দেশবাসী শুনতে থাকল শাহবাগ চত্বর থেকে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, লাখো তরুণের নবপ্রজন্মের জাগরণী গগনবিদারী আওয়াজ: ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’। আমাকে চমকিত করল একটি নব-অভ্যুত্থানের লাখো পদধ্বনি। এর কিছুদিন আগে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন ‘বিশেষ আদালত’। আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, যাক, আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুত বিচারকার্য শুধু নিছক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল না। কিন্তু কাদের মোল্লাকে যখন ঝুলিয়ে দেওয়ার আদেশ হলো না, তখনই মনে খটকা লাগল। প্রথম আলোয় পরদিন লিখলাম: ‘ফাঁসি কেন হলো না, জানতে চাই’।

প্রশ্নটির উত্তর পেলাম সাধারণ মানুষের মাঝে। সবাই জানতে চাইল, ‘ফাঁসির আদেশ হয়নি, নাকি দেওয়া হলো না,’ নানা মতের সব চমৎকার উত্তর পেলাম। ফাঁসি না হওয়ার কারণের সাফাই গেয়ে মুখচেনা একটি মহল নানা আইনি ব্যাখ্যা দিল। এই ছিল জনগণের আবেগ আর ক্ষোভকে তাত্ত্বিক যুক্তির নিচে চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা। আমি সেদিন সাধারণ মানুষের মনের কথাটি ব্যক্ত করে বলেছিলাম—আইনের ব্যাখ্যা বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি মূর্খ আমজনতার নেই। তাদের স্বতঃসিদ্ধ ধারণা ছিল, এত সব জঘন্য অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও ফাঁসির আদেশ না দেওয়ার জন্যই যেন সংশ্লিষ্ট আইনে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছিল।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এতৎসম্পর্কীয় টক শো আলোচনা আর সংবাদপত্রের বিজ্ঞজনের নিবন্ধাদি পড়ে বুঝলাম, বিচারকেরা নানা আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে জটিল সব ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, ‘ফাঁসি দেওয়া গেল না’। আলোচনায় সামনে এল, ১৯৭৩ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের একটি ধারা বাদ সেধেছে। তখন প্রবাদবাক্যটি স্মরণে এল, ‘জাস্টিস শুড নট অনলি বি ডান, ইট শুড বি টু হ্যাভ বিন ডান’। বিচারটি সঠিক হয়েছে বললে হবে না। সাধারণ্যে ন্যায়বিচার নয়, সুবিচারের বিশ্বাস জন্মাতে হবে। কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে সেই বিশ্বাস জন্মায়নি।

বিশ্বাসের ঘাটতি থেকেই শাহবাগ তথা প্রজন্ম স্কয়ারে একটি মহাজাগরণের মহা-অভ্যুত্থান ঘটেছে। কয়েক দিন আগে আরটিভির একটি টক শো-নামীয় হইচইয়ের ফাঁকে এ প্রশ্নটি করেছিলাম অংশগ্রহণকারী একজন আইনজ্ঞকে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আমাদের দেশের বাঘা বাঘা আইনজীবী, আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কেন নেওয়া হলো না? পরে শুনেছি, এতে আমাদের পণ্ডিতম্মন্য কয়েকজন আইন পেশাজীবী ক্ষুব্ধ হয়ে আমার প্রতি শ্লেষাত্মক মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘কেন, আমরা কি কম বুঝি?’ আমার উত্তর হচ্ছে, বেশি বোঝেন বলেই তো কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো গেল না। আইনের তৈরি ফাঁকটি বুঝতে পারেননি কিংবা বুঝতে চাননি কারও ইঙ্গিতে অথবা হুমকিতে।

ইতিমধ্যে যেসব আলোচনা করলাম, তার কিছু অংশ আমার গত শুক্রবার প্রকাশিত নিবন্ধের খণ্ডিত পুনরাবৃত্তি। এখন সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, তা নিয়ে মজাদার আর গুরুত্বপূর্ণ সব ধরনের আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমেই গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রের সাড়া জাগানো শব্দ-বৈচিত্র্যের সব শিরোনামের কথা বলছি। এসব শিরোনামের মূল খবরাদি পড়ে ভাবছি, এই যে নবজাগরণ, এর শেষ কোথায়? ৬২ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় এর উত্তর পেলাম না। কারণ, এ যে অনন্য, অতীত কোনো উদাহরণ নেই। সত্যি কথা বলতে, আমার সাংবাদিকজীবনে বিচিত্র ধরনের অনেক মহাসমাবেশ দেখেছি। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ক্ষমতা দখলের পর ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ’ করলেন, অবশ্য বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারি প্রশাসকেরা ঝেঁটিয়ে লোক নিয়ে এসেছিলেন। দেখেছি, পল্টনের অনেক মহাসমাবেশ। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, শেখ মুজিবের দুটি কথা শোনার জন্য, বস্তুত অনেকে তাঁদের চোখের দেখাটুকুর জন্য হাজারে হাজারে জড়ো হয়েছেন। সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক শোনার জন্য পাঁচ লক্ষাধিক নারী-পুরুষের সমাবেশ।

শাহবাগের জনতার, আবালবৃদ্ধবনিতার, নাতির হাত ধরে দাদার, মায়ের কোলে শিশু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মাকে পিঠে নিয়ে তরুণ ছেলেদের আগমনে সৃষ্ট মহাগর্জন: ‘ফাঁসি চাই’। অতীতে কখনো এসব সমাবেশে এমন দৃশ্য দেখিনি। ‘জয় বাংলা’ শুনেছি পাঁচ দশক কোটি কোটি কণ্ঠে। কিন্তু এমন গগনবিদারী ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনিনি, এমনিভাবে আকাশে-বাতাসে রণিত হয়নি তিন বছরের শিশু থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধের কণ্ঠে।
অবাক বিস্ময়ে ভাবছি, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না—কেন, কীভাবে, কোন মাধ্যমে এই মহাসমাবেশ, মহাসমুদ্রের গর্জন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে একূল-ওকূল ছাপিয়ে গেল? সেই যে রবির রচনাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, ‘আজি প্রভাতে সূর্য্য ওঠা সফল হলো কার’, তারই ধারাবাহিকতায় আবার রবিঠাকুরের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। মনের মাঝে গুনগুনিয়ে উঠেছে—
‘আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর।

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান?
না জানি আমি কেন রে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ
উথলে উঠিছে বারি।’
প্রাণের আবেগ, প্রাণের বাসনা
রুধিয়া রাখিতে নারি।

পুরো কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া গেল না। এখন প্রশ্ন উঠছে, উথলে ওঠা বারির স্রোত কোন দিকে প্রবাহিত হবে? নানা দিক থেকে বিভিন্ন পথে-বিপথে এই স্রোত প্রবাহিত করার নানা কূটকৌশল অবলম্বন করার একটি আভাস পাচ্ছি। এর একটি হলো, আইন সংশোধনের দোহাই দিয়ে মহাগর্জন স্তিমিত করার প্রচেষ্টা। তবু আমাদের বিজ্ঞ আইনজ্ঞদের ধন্যবাদ! শাহবাগের মহাসমাবেশ তাঁদের এটুকু জ্ঞান আহরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে পেরেছে। অথচ প্রায় দুই বছর ট্রাইব্যুনালে কথার ফুলঝুরি ছড়ানোর সময় তাঁদের এই বোধোদয় ঘটেনি কেন? নাকি বোধশক্তিটি চাপা দিয়ে রেখেছিলেন অথবা চাপা দেওয়া হয়েছিল?
শাহবাগের গগনবিদারী ধ্বনি তো আইন সংশোধনের দাবি নয়, তারা চায় ‘ফাঁসি’। তারা আপাতত শাহবাগ চত্বরে শুধু একটি আইনের ধারা পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছে না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হবে, সংসদে আইন পাস হবে, পুনর্বিচার বা আপিল হবে। সেই আপিলের রায় কী হবে, তা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? তাই শাহবাগের দৃপ্ত জনতা ওসব আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়তে চায় না। রায় তারা দিয়ে দিয়েছে: ফাঁসি চাই।

তবু একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় যদি উচ্চ আদালতে বহাল থাকে, তবে কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় আগাম চাওয়া হলো। তবে ‘আইন সংশোধন করছি, তোমরা যা চাও, তাই হবে’—এমন একটি স্তোকবাক্য দেওয়া যেতে পারে। মন্ত্রিসভা থেকে, সংসদ, তারপর উচ্চ আদালত, তারপর অনিশ্চিত রায়—শাহবাগের উত্তাল তরঙ্গ হয়তো স্তিমিত করার এই কৌশলটি কি কার্যকর হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘সবাই সাবধান! শাহবাগের জনস্রোতকে কে কোন দিকে নিয়ে যাবে, এ নিয়ে সজাগ থাকুন।’ এই সাবধানবাণী কি শুধু অপরের প্রতি নিক্ষেপ করলেন?

সরকারের আপিলের অধিকারটি আইনি স্বীকৃতি পাওয়ার পর নানা আইনি কূটচালের পর মোল্লা ঝুলতেও পারেন, অথবা কাশিমপুরে বাকি জীবন ঘাস কাটবেন। কিন্তু আসন্ন দুটি রায়—সাঈদী ও কামারুজ্জামানের মামলার রায়ের কী হবে? বেকায়দায় পড়া ট্রাইব্যুনাল রায়ের দিন শুধু পিছিয়ে দিয়ে আপাতত স্বস্তি পেতে পারেন। কিন্তু কত দিন রায় ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন? আর বিজ্ঞ মহল বলবে, ‘বিচার আপন গতিতে চলবে’। যাঁরা বেকায়দায় পড়েছেন, তাঁরা ভাবছেন, চলতেই থাকবে, চলতে চলতে সংশ্লিষ্ট মহলের নির্দিষ্ট মহলের ইঙ্গিতে এক জায়গায় থেমে যাবে। তত দিনে শাহবাগ চত্বর ফাঁকা হয়ে যাবে—এমনটি কি কেউ ভাবছেন? এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাংলাদেশ একটি আগ্নেয়গিরির ওপর অবস্থিত। বিসুভিয়াসের হাজার বছর লেগেছিল অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে। আমাদের লেগেছে কখনো পাঁচ, কখনো দশ, কখনো তারও বেশি। সাতচল্লিশ, চুয়ান্নতে এসে অগ্ন্যুৎপাতের লাভার স্রোতে ভেসে গেছে। একাত্তরে ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে লেগেছে ১০ বছর। সেই জ্বলন্ত লাভায় ভস্মীভূত হয়েছে পাকিস্তানি শাসকেরা। আইয়ুব, এরশাদকে জ্বলন্ত লাভায় ভাসিয়ে নিতে লেগেছে দুই দশক। এবারের অগ্ন্যুৎপাতে পঁচাত্তর থেকে ৩৮ বছর চাপা পড়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে কারা জ্বলে-পুড়ে খাক হবে, তাই দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

তাই তো অপেক্ষার প্রহর গণনায় শাহবাগের জাগ্রত বালক, তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের সলিল চৌধুরীর কবিতা উদ্ধৃত করে বলছি, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি। এখানে থেমো না।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

(প্রথম আলো, ১৩/০২/২০১৩)

No comments:

Post a Comment