Monday, December 31, 2012

আমেরিকার নামী প্রকৌশলী আরশাদ



আনিসুল হক | তারিখ: ০১-০১-২০১৩

  • প্রকৌশলী আরশাদ মাহমুদ প্রকৌশলী আরশাদ মাহমুদ

জুলাই ২০১২ সালে ভারতে বিদ্যুতের বিপর্যয় ঘটল। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা হলো একজন বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞের মত। হারিকেন স্যান্ডির কারণে আমেরিকার কোনো কোনো শহর যখন বিদ্যুৎবিহীন, এবিসি নিউজ তখন প্রকাশ করল একই বিশেষজ্ঞের বক্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রের এই নামকরা বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর অন্তত ১০০ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়েছে সিএনএন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ মূলধারার গণমাধ্যমে।
নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর বক্তব্য ছাপতে গিয়ে এ কথা জানাতে ভুলল না, তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্নাতক। নাম তাঁর আরশাদ মনসুর।
আরশাদ মনসুর যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎশক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইপিআরআই) জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট। গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান। তাঁর সঙ্গে কাজ করেন ৫০০ জন প্রযুক্তিবিদ। প্রতিষ্ঠানটি বৈশ্বিক। প্রতিবছর তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা তাঁর নেতৃত্বে ব্যয় করা হয় বিদ্যুতের গবেষণায়, যা ব্রাজিল থেকে জাপান—বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে। বিদ্যুৎ নিয়ে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে আরশাদের নিজের রয়েছে দুটি প্যাটেন্ট। শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কারিগরি জার্নালে, নানা দেশে বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত সম্মেলনে তিনি কতবার যে মূল বক্তা হয়েছেন, ইয়ত্তা নেই।
গত মে মাসে বাল্টিমোরে বিদ্যুৎশক্তি সম্মেলনে প্রধান বক্তা হিসেবে আরশাদ মনসুর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আপনাকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করবে। তিনি বলছেন, ‘গত ১০০ বছরে বিদ্যুৎশিল্পে যা ঘটেছে, আগামী ১০ বছরে তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুৎ খাতে এখন পর্যন্ত যত অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে, আগামী ২০ বছরে বিনিয়োগ করতে হবে তার চেয়েও বেশি।’
আরশাদ মনসুরের বাবা এস এ মনসুরও প্রকৌশলী, তাঁর ছিল বদলির চাকরি। চট্টগ্রাম স্টিল মিলের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। সেই সূত্রে আরশাদ মনসুর পড়েছেন চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে। বাবা গাজীপুরের বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিলে আরশাদ ভর্তি হলেন ঢাকার সেন্ট জোসেফ স্কুলে। তারপর নটর ডেম কলেজে। এস এ মনসুর এখনো ইংরেজি কাগজে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদি নিয়ে লেখেন। বাবার ডিএনএ ১৯৮৪ সালে ছেলেকে নিয়ে এল বুয়েটে। বুয়েটকে আরশাদ খুব গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যে পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এলাম, এর ভিত গড়ে দিয়েছে বুয়েট।’ তিনি খুব প্রশংসা করেন তাঁর বুয়েটের শিক্ষকদের। আর বলেন, আমেরিকার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় তাঁর সময়ে বুয়েটের পাঠক্রম উন্নততর ছিল। বুয়েট থেকে পাস করেন ১৯৮৯ সালে, তড়িৎ কৌশল বিভাগ থেকে। নয় মাস বুয়েটে শিক্ষকতা করেন। এরপর আমেরিকায় চলে যান। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস আর পিএইচডি করেন। ১৯৯৪ সালে টেনিসির নক্সভিলে ইপিআরআইয়ে যোগ দেন। ২০১১ সালে তাঁর পদোন্নতি হলো সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আর গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে। সেটিকেই তাঁর পেশাগত জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা বলে মনে করেন তিনি।
মায়ের কথা তিনি খুব স্মরণ করেন। মা চট্টগ্রামে এতিমখানা হাসপাতালে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন সেবামূলক কাজের জন্য, সেসব তিনি ভুলতে পারেন না। আর খুব কৃতজ্ঞ তিনি তাঁর স্ত্রী জাবিন মনসুরের প্রতি, যিনি নিজেও একজন পরিবেশ প্রকৌশলী। জাবিন একটা ব্লগ চালান, www.genocidebangladesh.org। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে এই পরিবার এক দণ্ডের জন্যও ভুলতে পারেনি। দুই মেয়ে নিয়ে তাঁরা বাস করেন শারলটে, যদিও আরশাদকে সারাক্ষণই উড়ে বেড়াতে হয় দেশ-বিদেশে।
আরশাদ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের উন্নত টেলিযোগাযোগব্যবস্থাকে বিদ্যুতের অপচয় রোধে এবং পিক আওয়ারে ব্যবহার হ্রাসে কাজে লাগানো যায়। প্রবাসীদেরই এগিয়ে আসা উচিত দেশের উন্নতির জন্য। বললেন আরশাদ, ‘আমাদের জ্ঞান আমরা কীভাবে জন্মভূমির উন্নতির জন্য কাজে লাগাতে পারব, এ ব্যাপারে আমাদেরই উদ্যোগী হতে হবে।’ দেশে অনেক দক্ষ ও যোগ্য লোক বিদ্যুৎক্ষেত্রে কাজ করছেন বলে তিনি মনে করেন। জ্ঞান ও প্রযুক্তির আদান-প্রদানের জন্য স্কাইপ, টেলিকনফারেন্সিং ইত্যাদি সহায়ক হতে পারে বলে তাঁর ধারণা।
আরশাদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের কাছে আমার জন্মঋণ, দেশে বহু কিছু শিখেছি, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আছে অনেক মহান উপাদান, তেমনি আমেরিকায়ও অনেক কিছু শিখেছি। আমেরিকা হচ্ছে সেই দেশ, যা একজন নাগরিকের বর্ণ, জাত, ধর্ম ইত্যাদি বিবেচনা করে না; বিবেচনা করে তার যোগ্যতা—এর প্রমাণ হলো একজন তরুণ প্রকৌশলী থেকে আমার ইপিআরআইয়ের কারিগরি দলের প্রধান হওয়া।’
আরশাদ কিন্তু হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন। একদিন তাঁর চার বছরের ভাতিজা স্নানঘরে পড়ে গিয়ে আহত হলে আরশাদ তাকে নিয়ে ছুটলেন পিজি হাসপাতালে। শিশুটিকে সেলাই দেওয়ার দৃশ্য দেখে আরশাদ নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, বুয়েটের দরজা তখনো বন্ধ হয়ে যায়নি। আরশাদ মনসুর বুয়েটে ভর্তি হলেন। আজ ২৯ বছর পর আমরা বলতে পারি, ওই দুর্ঘটনা জগৎসভায় একজন নামকরা বাংলাদেশি আমেরিকান প্রকৌশলীর আবির্ভাবের দরজা খুলে দিয়েছিল।

ফিরে দেখা -৭৩ : স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যাত্রা শুরু : ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ, জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার

ফিরে দেখা -৭৩ : স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যাত্রা শুরু : ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ, জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার

জাকির হোসেন




আজ ১ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ছাত্র, জনতা এবং সাংবাদিকের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের বছরকাল পার না হতেই বিরোধী দমনে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এদিন শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশ বেপরোয়া ও নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র মির্জা কাদেরকে হত্যা করে। এ সময় গুরুতর আহত হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম, দৈনিক বাংলার বাণীর ফটোসাংবাদিক রফিকুর রহমানসহ ৬ জন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আহূত দেশব্যাপী ‘ভিয়েতনাম দিবস’-এর কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকায় সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ভিয়েতনামের মার্কিনীদের বর্বর বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ বেলা সোয়া ১২টায় মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে ছাত্রদের ওপর বিনা প্ররোচনায় গুলি চালায়। গুলির আগে পুলিশ কোনো রকম হুশিয়ারি দেয়নি। লাঠিচার্জ বা ফাঁকা গুলিও করেনি। ছাত্রহত্যার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাজধানীর দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অফিস আদালতের লোকজন রাস্তায় নেমে আসে। চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তারা সোচ্চার কণ্ঠে হত্যার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। বিক্ষোভ মিছিলে উচ্চারিত স্লোগানগুলো হচ্ছে—‘নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই,— এক রশিতে ফাঁসি চাই,’ ‘শহীদ মতিউল-কাদেরের রক্ত— বৃথা যেতে দেব না,’ ‘খুনি মান্নানের— ফাঁসি চাই,’ ‘খুনিশাহী মুজিবশাহী ধ্বংস হোক,’ নিক্সনের দালালি করা চলবে না,’ ‘বাংলার মীরজাফর শেখ মুজিব। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে পরদিন অর্থাত্ ২ জানুয়ারি (১৯৭৩) স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। আর এদিন পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সমাবেশে ডাকসুর পক্ষ থেকে তত্কালীন সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাস সেলিম আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে দেয়া জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নেন এবং ‘ডাকসু’র আজীবন সদস্য পদ বাতিল করেন। এসব ঘটনা ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ঘটনার পরদিন দৈনিক গণকণ্ঠ প্রথম পৃষ্ঠায় ‘অশ্বমেধের লালঘোড়া’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এ সম্পাদকীয়টিসহ দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো—

অশ্বমেধের ‘লালঘোড়া’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশেপ্রেমিক ছাত্র-যুবকের বুকের তাজা রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে তাদের নববর্ষের যাত্রা শুরু করেছে। বিশ্বের প্রতিবাদী মানুষ যখন ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন দস্যুদের নির্বিচার হত্যালীলায় ঘৃণায় ক্ষোভে চিত্কার করতে করতে পৃথিবীর প্রতিটি শহর বন্দরের রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে নেমে এসেছে, তখন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ঢাকা শহরের রাজপথে তেমনি একটি মিছিলের ওপর মানবতার বক্ষস্থলকে নিশানায় এনে তাদের পূর্বে কথিত ‘লালঘোড়ার’ অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেছে। বিশ্ব মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে ভিয়েতনামে মার্কিন হত্যালীলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবারা যখন একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে তোপখানা রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি অতর্কিত এই গুলিবর্ষণ। এই গুলিবর্ষণের ফলে ঘটনাস্থলেই দু’জন ছাত্রযুবা শহীদ হয়েছেন এবং ৬ জন মারাত্মকভাবে জখম হয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়েছেন। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন শহর বিক্ষোভ ও ধিক্কার ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। শহরের রাজপথ বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে প্রকম্পিত হতে থাকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সত্যিকারের স্বরূপ উপলব্ধি করে ঢাকায় জনসাধারণ যেত হতচকিত হয়ে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের অশ্বমেধের লালঘোড়া নিরীহ ছাত্র-যুবাদের ওপর দিয়ে এভাবেই চলতে শুরু করল? এত তাড়াতাড়ি? কিন্তু বোকা শাসকরা কি জানে না যে, সদ্য উত্থিত এই জাতি রক্তের লালপথ ধরে আজ এতদূর উঠে এসেছে। রক্তের বন্যায় তারা সর্বধরনের অন্যায়কে ভাসিয়ে দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে। তাদের পেছনে পড়ে আছে নূরুল আমীন-আইয়ুব-ইয়াহিয়া-মোনেমের বন্দুক কামানের মুহুর্মুহু গর্জন আর রাজপথ ভরা চাপ চাপ রক্তের দাগ। এ চলা থামবে না। বর্তমান ক্ষমতাসীনদের রাইফেলের গর্জন যত বাড়বে, ততই এ চলা দুর্দম হয়ে উঠবে। আর ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে আজকের ক্ষমতাদর্পী গুলিবর্ষণকারীরা। কোনো সাম্রাজ্যবাদই তাদের পুতুলদের দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ০২ জানুয়ারি ১৯৭৩)

পল্টনের ঘোষণা
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)গতকাল মঙ্গলবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে শহীদ মতিউল ইসলাম ও শহীদ মির্জা কাদিরুল ইসলামের লাশকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিম্নোক্ত ঘোষণা পাঠ করেন। এই সমাবেশের সামনে ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে, বিগত ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়েছিলাম ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আজ সেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নিলাম। আমরা দেশের আপামর জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে তার বঙ্গবন্ধু বিশেষণ ব্যবহার করবেন না। একদিন ডাকসুর পক্ষ থেকে আমরা শেখ মুজিবকে জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না। শেখ মুজিবুর রহমানকে একদিন ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল। আজকের এই সমাবেশ থেকে ডাকসু’র পক্ষ থেকে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হলো। ( দৈনিক সংবাদ : ০৩ জানুয়ারি ১৯৭৩)

পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র হরতাল, বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ খুনিদের ফাঁসি চাই : পল্টনের দাবি
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক : শহীদ মতিউল ও শহীদ কাদিরুলের পবিত্র লাশ সামনে রেখে এদেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর নেতারা গতকাল (মঙ্গলবার) পল্টনের বিরাট সমাবেশে ছাত্রহত্যার জন্য দায়ী খুনিদের ফাঁসি দাবি করছেন— সেই খুনি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু যে কোনো মন্ত্রী বা আমলাই হোক না কেন।
বিকাল ৩টায় ‘ডাকসু’ সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই শোক বিধুর অথচ বিক্ষুব্ধ সমাবেশে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নূহউল আলম লেনিন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম মুকুল, সহ-সম্পাদক কামরুল আহসান ও ডাকসু সম্পাদক মাহবুব জামান।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ডাকসুর সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আজ যেন শোকের দিন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তান আমলেও পাঁচ বছর পর ছাত্রদের ওপর গুলি ছোড়া হয়েছিল। আর মুজিব এক বছরও যেতে দিলেন না। শেখ মুজিব আজ নুরুল আমিনের পদাঙ্ক অনুস্মরণ করে তারই সমপর্যায়ে চলে গেছেন। ১৯৫৪ সালে যেমন ছাত্র হত্যাকারী নুরুল আমীন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তেমনি আগামী নির্বাচনে মুজিবও নিক্ষিপ্ত হবে।
কুলাঙ্গার তোফায়েল : ১ জানুয়ারি ঘটনা উল্লেখ করে সেলিম বলেন যে, লজ্জার বিষয় যখন মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন একদা ছাত্রনেতা জনাব তোফায়েল আহমদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মান্নান ও পুলিশের আইজির সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে বসে ছাত্র হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন। আজ থেকে আমরা তাকে ‘ছাত্র সমাজের কুলাঙ্গার’ হিসেবে অভিহিত করতে চাই।
লাশের ওপর ঢিল : সেলিম বলেন, শেখ মুজিবের চেলাচামুণ্ডাদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আজ আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহীদ কাদিরের লাশ নিয়ে আসছিলাম তখন মুজিববাদী ছাত্রলীগ লাশের ওপর ঢিল ছুড়ে, মিছিলের ওপর হামলা চালায়। তিনি বলেন যে আজ থেকে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত ‘মুজিববাদ’ ছাত্র সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হলো।
লাল ঘোড়া : ডাকসুর সহ-সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর লালঘোড়া দাবড়ানোর কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি ছাত্র সমাজের ওপর দিয়েই তা চালু করলেন। তিনি বর্তমান সরকারকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ছাত্রসমাজ শুধু গড়তেই জানে না ভাংতেও জানে। কী করে খুনি জালেম সরকারকে উত্খাত করে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিতে হয় ছাত্র সমাজ তা জানে। আগামী দিনে ছাত্র জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং তা শুধু হরতাল মিছিলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
আবদুল কাইয়ুম মুকুল : ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম মুকুল সরকারী প্রেসনোট টুকরো টুকরো ছিড়ে ফেলে বলেন যে, এমন মিথ্যা ভাওতা জনগণ ঔপনিবেশিক আমলেই ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন যে খুনির দুঃখ প্রকাশের কোনো অধিকার নেই। (দৈনিক সংবাদ : ৩ জানুয়ারি ১৯৭৩)

শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল বটতলার প্রতিবাদ সভায় ধিক্কার
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পুলিশের বর্বর গুলি ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এতে সভাপতিত্ব করেন। সভাশেষে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মম গুলির শিকার শহীদ মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদেরের লাশ নিয়ে এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে শহরের প্রধান রাজপথগুলো প্রদক্ষিণ করে বায়তুল মোকাররমে এসে সমাপ্ত হয়। বায়তুল মোকাররমে এক বিক্ষোভ সভায় বক্তৃতা করেন ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও ডাকসুর সহ সভাপতি জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও শ্রমিক জনতা যোগদান করে। তারা সোচ্চার কণ্ঠে হত্যার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। বিক্ষোভ মিছিলে উচ্চারিত শ্লোগানগুলো হচ্ছে—‘নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই,—এক রশিতে ফাঁসি চাই,’ ‘সাম্রাজ্যবাদের মরণ ফাঁদ—১৯৭৩ সাল,’ ‘শহীদ মতিউল-কাদেরের রক্ত বৃথা যেতে দেব না,’ ‘খুনি মান্নানের— ফাঁসি চাই,’ ‘ভিয়েতনামের বদলা নেব, বাংলাদেশের মাটিতে, ‘আগামীকাল হরতাল, গাড়ির চাকা ঘুরবে না, খুিনশাহী মুজিবশাহী ধ্বংস হোক, ‘নিক্সনের দালালি করা চলবে না,’ ‘সমাজতন্ত্রের নামে ভাওতা দেয়া চলবে না,’ ‘বাংলার মীরজাফর শেখ মুজিব।’ (দৈনিক সংবাদ : ২ জানুয়ারি ১৯৭৩)

Friday, December 28, 2012

ইসলামী দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ


ইসলামী দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ


আলী হাসান তৈয়ব

সম্পাদনা : . মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

2012 - 1434
ইসলামী দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের বিজয় বা স্বাধীনতা দিবস এলেই কিছু মানুষকে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে দেখা যায়। এ সুযোগে তারা নিজেদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইসলাম বিদ্বেষ কিংবা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা পরোক্ষে বলতে চান, ১৯৭১ সালে আমরা যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের জুলুম-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নয়; ইসলামের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে এ দেশের লাখ লাখ মুসলিম প্রাণ দিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষবাদ কায়েমের জন্য। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, ইসলাম থেকে বিযুক্ত হবার উদ্দেশে!
এমন জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি বা মিথ্যাচার এ দেশে আর কেউ করেনি। তথাকথিত সুশীল নামের কিছু ব্যক্তি যে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। কারণ, সত্য হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধটি ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ হয় কীভাবে, ইসলামই তো মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের প্রেরণা ছিল। কেননা জুলুম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামই সবচে বেশি সোচ্চার। গোড়া থেকেই ইসলাম জুলুম সহ্য করে নি। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বারবার জুলুম থেকে বারণ করা হয়েছে। নানা উপলক্ষ্যে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। উপরন্তু জুলুম প্রতিরোধে ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে।
বরং তেতো সত্য হলো, এখন যারা অতি কষ্টে পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে তাদের ইসলামবিদ্বেষ চরিতার্থের ব্যর্থ প্রয়াস চালান, এদের কেউ কেউ যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। আজ যেমন তাদের স্ত্রীরা হিন্দি সিরিয়াল আর শিশুরা হিন্দি ডোরেমন নিয়ে মাতোয়ারা থাকেন। হিন্দি গান ও নাচ ছাড়া তাদের কোনো অনুষ্ঠানই যেন জমে না। অবাক লাগে, আজও যখন স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত রয়েছে অনেক পঙ্গু বা আহত মুক্তিযোদ্ধা, তখন এসব সুবিধেবাদী ব্যস্ত স্বাধীনতার চেতনার নামে নিত্য নতুন বিভেদ সৃষ্টিকারী তত্ত্ব ও বানোয়াট তথ্য আবিষ্কারে। তখন যারা জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছিলেন সেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু কখনোই এসব ভাবেননি কিংবা আজও তেমন ভাবেন না।
মরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র বা চলচ্চিত্র কিংবা পরিবারের কাছে রণাঙ্গণ থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্র দেখলেই সে কথা জানতে পারি। এসব থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গণে যাবার আগে আল্লাহর কাছে সালাত আদায়ান্তে মুনাজাত করে রওনা হয়েছেন। বাবা, মা বা স্ত্রীর অশ্রুসজল চোখের দিকে চেয়ে তাঁদের হৃদয় নিংড়ানো দু আর কায়োমন প্রার্থনা শুনেই তাঁরা ছুটেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা একজনও সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা ক তা জানতেন বলে মনে হয় না। অথচ অমুক্তিযোদ্ধারাই এসব চেতনা চাপিয়ে দিচ্ছে আজ আমাদের পর।
বছর খানেক আগে আমি গিয়েছিলাম শেরপুরের এক সীমান্তঘেঁষা পল্লী মরিয়ম নগরে। খ্রিস্টান মিশনারির তৎপরতায় সেখানে অনেক মুসলিম নর-নারী খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে ময়মনসিংহের কিছু উদ্যমী ও দায়িত্বসচেতন আলেমের তৎপরতায় আবার তাঁরা ইসলামে ফিরে আসেন। ই গ্রামে একটি ইসলাম সম্মেলনে আয়োজন করা হয়েছিল ইসলামের সুমহান শান্তির বাণী এবং শ্রেষ্ঠত্বের অনস্বীকার্য বাস্তবতা তুলে ধরতে। আলোচক হিসেবে সেখানে যাবার সময় দুর্গম পথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গে। নাম মনে না থাকলেও ভদ্রলোকের শ্মশ্রুমণ্ডিত টুপি-পাঞ্জাবিপরা ইসলাম অন্তপ্রাণ চেহারাটি মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে। দুর্গম পথে এক পর্যায়ে তিনি আমাদের সঙ্গী হলেন পথপ্রদর্শক হিসেবে।
গাড়িতে পাশের সিটে বসে আমি দাদার বয়েসী ওই মুরুব্বির ছোট্ট একখান সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম। জানালেন কদিন পরেই তিনি ঢাকায় আসছেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তাঁর মুখে এ প্রসঙ্গ শুনতেই আমার মনে হলো তাঁকেই জিজ্ঞেস করা দরকার আমার দীর্ঘদিনের লালিত সেই মোক্ষম প্রশ্নটি। আচ্ছা বুযুর্গ, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন কী উদ্দেশ্যে? ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম করা বা ইসলাম নির্মূল করার কোনো অভিপ্রায় ছিল কি তখন কোনো মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে?
দ্ব্যর্থহীনভাষায় তাঁর উত্তর : বাবা, এসব হলো এখনকার মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসায়ীদের স্বার্থান্ধ দাবীআমরা লড়াই করেছি জালেম হটিয়ে মজলুমদের বাঁচাতে। ইসলামই আমাদের সে প্রেরণা যুগিয়েছেইসলাম কখনো জালেমের পক্ষে নয়। ইসলাম সবসময় জালেম নির্মূল করতে বলে। আচ্ছা, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কজন আছেন যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস নিয়ে মরেন নি? তাঁরা সবাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেই লড়াই করেছেন। এই সম্পদ বুকে নিয়েই শহীদ হয়েছেন। আমরা সবাই ফজর নামাজ পরে আল্লাহর কাছে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মুনাজাত করেই চলে গেছি যুদ্ধক্ষেত্রে।
আমার ভোলার বন্ধু চিন্তাশীল তরুণ লেখক মাওলানা আবুল কাসেম আদিল এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, তার বাবা ও চাচারাও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মুখে তিনি একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধের তখনকার চেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছেন। তাঁরাও ওই শেরপুরের স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধার মতো জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের চেতনা তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার ধর্ম পরায়ন বাবা এবং চাচারাও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা লালন করতেন না, এটা বুঝার জন্য আমার আর কোনো প্রমাণের দরকার নেই।
আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের চেয়ারম্যান সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলি সহস্রাধিক পৃষ্ঠার শেকড়সন্ধানী একটি ঢাউস বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত সেই বইটির নাম ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’। এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায় শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেবার রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। বইটির প্রকাশনা উৎসবে আমন্ত্রিত দেশের প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন স্পষ্ট বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। ঢালাওভাবে আলেমদের কিংবা টুপি-দাড়ি দেখলেই রাজাকার বলা স্বাধীনতার চেতনা নয়।
বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার শুরুতেই পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। সেখানে যে মাওলানা সাহেব কুরআন তিলাওয়াত করেছিলেন তাঁর ছোট ভাই স্বনামখ্যাত লেখক অনুবাদক মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর মুখে তার গৌরবদীপ্ত বর্ণনা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন সেখানে তাঁর শেষ উক্তি ছিল, ‘...এদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ এই ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দের মধ্যেও তাঁর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভরসার চেতনা ফুটে ওঠে। তাঁর বক্তব্য থেকেও তো কখনো মুক্তিযু্দ্ধকে ইসলামের বিপক্ষে যুদ্ধ বলে মনে হয় নি।
যে দেশের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের প্রেরণা ছিলেন, যে দেশের জেলখানায় তিনি বিনা বিচারে ৯ মাস বন্দি ছিলেন, সে দেশের প্রতি তিনি প্রসন্ন হতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তিনি পাকিস্তানে ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করেন। নিজের ক্ষোভ ও কষ্ট মনে পুষে রেখে তিনি এতে যোগদান করেন কেবল ‘উম্মাহ চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে। এটিও তার ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতাকে সপ্রমাণ করে
আমার ব্যক্তিগত পড়াশোনায় দেখেছি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরাম এমনকি বিশ্বের শীর্ষ আলিমগণও এই যুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বৈধ উচিত লড়াই বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত আলেম সাবেক বিচারপতি মুফতি তাক উসমানীর বিশ্বভ্রমণকাহিনীর বই জাহানে দীদাহ’–এর বাংলাদেশ ভ্রমণ অংশে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক স্কলার . ইউসুফ আল-কারযাবর ভ্রমণকাহিনীর বাংলাদেশ অধ্যায়েও এ সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বলেই আখ্যায়িত করেছেন।
অবশেষে প্রার্থনা, আল্লাহ বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের ঈমানকে হেফাযত করুন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ইসলামের সেবক ও রক্ষক বানিয়ে দিন। আমীন।

জনতার হাটে সম্ভ্রম বিক্রি

জনতার হাটে সম্ভ্রম বিক্রি
-আবু বকর সিরাজী
১০ই ডিসেম্বর ২০১০ ইং ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে ২৫ হাজার দর্শক মেতে উঠেছিল আনন্দমেলায়। অশ্লীল নৃত্য আর উলঙ্গ বেহায়াপনায়। সেদিন বলিউড কিং শাহরুখ খানের লাইভ শো কিং খান লাইভ ইন ঢাকাঅনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের পঁচিশ হাজার দর্শককে মাতাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন শাহরুখ খান। তাকে সঙ্গ দেয় ভারত থেকে আসা সহশিল্পীরা। অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে রানী মুখার্জী, অর্জুন রামপালসহ দলের অনেকেই।
একটি বিদেশী সংস্কৃতি নিয়ে ঢাকায় বেশ কিছুদিন মাতামাতি চলে। টিকিট বিক্রি, প্রচার-প্রসার, বিলবোর্ড স্থাপন, রেডিও টিভিতে শোরগোর, মোবাইল কোম্পানিগুলোর উপরি আয়- সব মিলে এক পাগলামো বখাটেপনা!
টিকিটের দাম ছিল সর্বনিম্ন ৩,০০০ এবং সর্বোচ্চ ৫০,০০০ টাকা। পঁচিশ হাজার দর্শক টিকিট বাবদ মোট কত টাকা বহন করেছে তা সহজেই অনুমানযোগ্য। গড় হিসেবে তা অর্ধশত কোটি টাকার কম নয়!
আয়োজকরা প্রথমে বলেছিলেন শাহরুখকে দেয়া হবে ৫৫ লাখ টাকা। হাস্যকর বটে। শাহরুখ যেখানে নিজ দেশেই পাঁচ-ছয় কোটি রুপির কমে কনসার্ট করেন না, সেখানে অন্য দেশে এসে সে দেশের টাকার হিসেবে মাত্র ৫৫ লাখ টাকায় কনসার্ট করবেন? একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুও মনে হয় তা বিশ্বাস করবে না। তাই স্বভাবতই এনবিআরও তা বিশ্বাস করে নি। ফলে আটকে দেয়া হয় শাহরুখের আগমনযাত্রা। তার আসার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। করের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় কাস্টমসের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র আটকে দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে দেনদরবার করতে-করতে অফিস সময় শেষ হয়ে যায়। এবার উপায়! উপায় সরকারী ঊর্দ্ধতন মহল। কিন্তু তারাও তখন সংসদে ব্যস্ত। ফলে আয়োজক কমিটি পড়ে মহা ফ্যাসাদে।
কিন্তু যে সমাজ পাপের জন্য চাতক পাখির মতো হা করে থাকে, সেই সমাজে এ ধরনের এক অনুষ্ঠান আটকে যাবে শুধু দেশের স্বার্থে! তা কী করে হয়? তাই আঁধারের চুক্তিতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। পর্দার আড়ালে কত হিসেবরই তো ল্যাঠা চুকে যায়! এটার পরিণতিও যে সে রকম কিছু একটা হয়েছিল, তা অনুমান করতে বেশি জ্ঞান থাকার দরকার হয় না।
শাহরুখ আসেন তার বিশাল বাহিনী নিয়ে। পরের সংবাদে জানা যায়, এক শাহরুখ খানকেই দেয়া হয়েছিল ১৮ কোটি টাকা। তারপরেও এনবিআর তাতে সন্দেহ পোষণ করেছে। তাদের ধারণা, প্রকাশ্যে এই পরিমাণ টাকার কথা উল্লেখ করা হলেও মূল পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
বাংলাদেশের এই সময়টাতে এমনিতেই ইভটিজিং মহামারীর আকার ধারণ করেছে। আদালতে পর্দা-বোরকার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পর থেকেই ব্যাপারটি আল্লাহর গযব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর এর জ্বালানী সরবরাহ করছে অশ্লীল নাচগান, মোবাইল ব্লু-ফিল্ম, বিভিন্ন রকমের অপসংস্কৃতি বিশেষ করে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। এমন এক নাযুক মুহূর্তে ভারতীয় উদ্দাম সংস্কৃতি আমদানী করা হলো!
শাহরুখ খানের উপস্থিতিতে লোকে লোকারণ্য হয় আর্মি স্টেডিয়াম। কিং খানের ভক্তদের পদভারে স্টেডিয়ামের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। অনুষ্ঠানে প্রভাবশালী এক প্রতিমন্ত্রীকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে চেয়ার খালি না থাকার কারণে!
যারা সরাসরি অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারে নি, তারা ভিড় করে টিভির সামনে। বৈশাখী টিভির কল্যাণে (?) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও এই অপসংস্কৃতির নোংরা দৃশ্য দেখে চোখ কচলানোর সুযোগ পায়!
বিপুল আয়োজন, উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে যে অনুষ্ঠানে পঁচিশ হাজার দর্শক মস্তি করতে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তারা ইসলামী ভাবধারার কোনও সংস্কৃতিক চিন্তা লালন করেন না কিংবা তা নিয়ে ভাবারও সময় হয়ে ওঠে না তাদের। সে হিসেবে দর্শকরা অনুষ্ঠানের সব কিছুতে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের সৃষ্টিগত রুচি-আভিজাত্য বলে তো একটা ব্যাপার আছে! তাই অনুষ্ঠানের কিছুসংখ্যক রুচিশীল দর্শক সবকিছু সমর্থন করতে পারেন নি। বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত পোশাকে প্রায়নগ্ন ভারতীয় ললনাদের উদ্বাহু নৃত্য আর ভারতীয় সংস্কৃতি তুলে ধরার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি।
কিং খানের গ্রান্ড শো নিয়ে দর্শকদের যত আগ্রহ ছিল, তা মিইয়ে গেছে নিমিষেই। এসব অনুষ্ঠানে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনা ছাড়া আর কিছু পাওয়ার আশা থাকে না কারও, কিন্তু নতুনত্ব বা সৃজনশীল কিছু আশা করেন দর্শকরা। কিন্তু তা থেকেও বঞ্চিত হন তারা। স্যাটেলাইট চ্যানেলে হরহামেশা যা দেখে থাকেন তারা, সরাসরী অনুষ্ঠানে এসেও তারই খণ্ডচিত্র দেখতে হয় তাদের। আর যারা সপরিবারে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন, তাদেরকে লজ্জায় মাথা কুটতে হয়েছে। বিব্রত অসহায় হয়ে তাদেরকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। স্বল্পবসনা সহশিল্পীদের উদ্দাম নৃত্য টিভিদর্শকদেরকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে। এসব দর্শকরা বলেছেন, এধরনের উলঙ্গনৃত্য সাধারণত গুলশানের বিশেষ কিছু ক্লাব বা পাঁচতারা হোটেলগুলোতে হয়ে থাকে। কিন্তু আয়োজকরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উলঙ্গনৃত্যকে দর্শকের একেবারে মুখের সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন! পথভ্রষ্টতার যে পথ তারা আবিষ্কার করলেন, এদেশের সম্ভ্রমহারা মানুষ তাদের দীর্ঘশ্বাসের সময় স্মরণ করবে তাদের অবদানের (?) কথা!
এবার আসল কথায় আসা যাক। বেপর্দা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন মানুষের মর্যাদা, নৈতিকতা আর সম্ভ্রমবোধ অধঃপতনের কোন্ তলানীতে নিয়ে যেতে পারে, তার ক্ষুদ্র একটা ধারণা পাওয়া গিয়েছে এই নৃত্যবখাটেপনার মাধ্যমে।
অনুষ্ঠান শুরু হয় ৮টা ৭ মিনিটে। শাহরুখ মঞ্চে আসেন ৮টি ৪২ মিনিটে। তার সঙ্গে আসা উলঙ্গ নৃত্য শিল্পীদের সঙ্গে গান ও পারফর্ম করার পর তিনি সবচেয়ে ন্যাক্করজনক ঘটনাটার জন্ম দেন। মঞ্চের সামনে বসা এক দম্পতিকে তিনি মঞ্চে ডেকে নেন। লায়লা নামের ওই মহিলাটিকে স্বামীর সামনেই তিনি আলিঙ্গন করেন। অসহায় স্বামী আধা হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন নিজ স্ত্রীকে অন্যের বাহুলগ্ন হওয়ার নির্মম দৃশ্য! কিন্তু এখানেই শেষ নয়লম্পটরা কখনও এতো অল্পতে শেষ করে না। তাই শাহরুখ আলিঙ্গন থেকে মুক্তি দিয়ে ওই মহিলাকে চুম্বন করতে থাকেন বারবার!
একজন মহিলাকে স্বামীর সামনে হাজার-হাজার উপস্থিত দর্শক আর লক্ষ-লক্ষ টিভি দর্শকের সামনে চুম্বন করার দৃশ্য কতটুকু বেদনা ও লজ্জার তা বলে শেষ করা যায়! একজন মানুষের মধ্যে যদি বিন্দু পরিমাণ হায়া-লজ্জা থাকে, তাহলে কী সে এই ঘটনা দেখার পর বেঁচে থাকাকে প্রাধান্য দিতে পারবে? অবশ্য এটা আমাদের মূল্যায়ন। হয়ত আমরা এটাকে বেদনা ও লজ্জার মনে করছি। কিন্তু ওই স্বামী এবং চুম্বনখাওয়া স্ত্রী যদি নিজেদেরকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন? স্বামী যদি মনে করেন, আমার কত সৌভাগ্য, আমার চুম্বনের স্থলে কিং খান চুম্বন এঁকেছেন, আমার আলিঙ্গনের স্থানে তিনি আলিঙ্গন করেছেন! স্ত্রী যদি মনে করে, জীবন আজ ধন্য, কিং খান আমাকে চুম্বন দিয়ে ধন্য করেছেন! সারা জীবন যদি তিনি পরিচিত আর স্বজনদের কাছে এ নিয়ে গর্ব করেন!
এই ধারণা মোটেও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। সংবাদে প্রকাশ, শাহরুখ তাকে নিয়ে মস্তি করার সময় সে খুব উৎফুল্ল ছিল এবং আনন্দের আতিশয্যে সে বারবার নিজের পরিচয় দিয়ে বলছিল, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমার দাদি। হয়ত সে মনে করেছিল, আজ যে সৌভাগ্যের মালা সে গলায় জড়িয়েছে এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ না করলে কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় না। সত্যি যদি সে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রীর নাতনী হয়ে থাকে, তাহলে সে তার দাদির কতটুকু সম্মান বাড়ালো, এতে তার সম্মান বাড়লো না কমলো, তা যেন দাদি যাচাই করে দেখেন। কারণ হাদীসে আছে-
فَالْعَيْنَانِ تَزْنِيَانِ وَزِنَاهُمَا النَّظَرُ، وَالْيَدَانِ تَزْنِيَانِ وَزِنَاهُمَا الْبَطْشُ،
চোখ ব্যভিচার করে, চোখের ব্যভিচার হলো অবৈধ পাত্রে দৃষ্টি দেয়া। হাত ব্যভিচার করে, হাতের ব্যভিচার হলো অবৈধ নারীকে ধরা, (মুখ ব্যভিচার করে। মুখের ব্যভিচার হলো অন্য নারীকে চুম্বন করা)।’ [মুসনাদ আহমদ : ৮৫২৬]
লায়লা কি শাহরুখের জন্য বৈধ ছিলেন? তাকে ধরা, স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা কি শাহরুখের জন্য বৈধ ছিল? হাদীসের ভাষ্যমতে সেটা কি ব্যভিচার নয়? হয়ত ছোট ব্যভিচার। পঞ্চাশ টাকার নোটও টাকা, একশ টাকার নোটও টাকা এবং পাঁচশ টাকার নোটও টাকা। কিন্তু এক হাজার টাকার নোটের তুলনায় ছোট। তাই বলে তো টাকার বাইরে নয়। শুধু সরাসরি যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াই ব্যভিচার নয়। উল্লিখিত বর্ণনা অনুযায়ী পরনারীকে ধরা, আলিঙ্গন করা এবং চুম্বন করাও ব্যভিচার। আর প্রকাশ্য জনসমুদ্রে এরূপ ব্যভিচার করে কেউ যদি গৌরববোধ করে এবং আনন্দের আতিশয্য নিজের পরিচয়টা লুকিয়ে রাখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রীকে নিজের দাদি পরিচয় দেয়, তাহলে এখানে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
শুধু লায়লাই নয়, শাহরুখের আলিঙ্গন আর চুম্বন পাওয়ার জন্য আরও অনেকেই মুখিয়ে ছিলো। হুমায়রা হিমু নামের এক অভিনেত্রী নাকি শুধু হাসফাস করেছে তাকে কখন শাহরুখ মঞ্চে ডেকে নেবে এই আশায়! হায় সমাজ! ব্যভিচারটাকে তুমি এত সহজে আপন করে নিতে পারলে?
অবশ্য কখনও কখনও মন আমার ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই সমাজের পঁচনটা শুরু হয়েছে ঠিক; কিন্তু এখনই তা এত গভীর পৌঁছেছে বলে মনে হয় নি, যার কারণে একজন স্বামী নিজের সামনে স্ত্রীকে পরপুরুষের বাহুলগ্না হতে দেখে, চুম্বিত হতে দেখেও কিছু মনে করবে না, তার পৌরুষের আঁতে ঘা লাগবে না। আমি যখন দুয়েকজনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি, তারা আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন নি। তারা বলেন, দেখুন গিয়ে, ওই দম্পতি নির্ঘাত গৌরববোধ করছে। বন্ধু-বান্ধবদের বলে বেড়াচ্ছে যে, দেখ দেখ...
ওই দম্পতির মানসিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন, এই ঘটনাটি কিন্তু আমাদেরকে দারুণ শঙ্কিত করেছে। বেপর্দা, মুক্তবাসের ছোবল আমাদের দেশে এভাবে এত জোরে এখনই হানা দেবে তা আশা করিনি। মানুষের রুচিবোধ এত গলিজ হবে, তাও মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাই যারা এখনও কিছুটা দূরে আছেন, তারা সতর্ক হন এবং পতনের এই তুফান থেকে নিজের পরিবার, দেশ ও সমাজকে রক্ষা করুন। ইসলামী সভ্যতা, ইসলামী রুচিবোধ ও পর্দার নিরাপদ জীবনে অভ্যস্থ হোন। ইসলাম আপনাকে ঠকাবে না, যিল্লতীর হাত থেকে বাঁচাবে কেবল।