১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাতির ক্রান্তিলগ্নে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে
জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসানো হয়। তাই তিনি বলেছিলেন,
‘জনগণই সকল ক্ষমতার উত্স’ অর্থাত্ গণতন্ত্র একমাত্র পথ। তার ক্ষমতার প্রতি
লোভ ছিল না। জিয়া প্রেসিডেন্ট হয়ে বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি আমাকে টেনে আনে।’
বাংলাদেশের মানুষ দেখল, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেষ প্রহরে (ভোর) তিনটায় তার
কণ্ঠে যে রকম ধ্বনি বেজে উঠেছিল ‘আমি মেজর জিয়া’, ঠিক তেমনই ১৯৭৫ সালের ৭
নভেম্বর শুক্রবার ভোরে আবার ইথারে বেজে উঠল, ‘আমি জেনারেল জিয়া বলছি...।’
তিনি জাতির উদ্দেশে তার প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে
বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার
এবং অন্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। এ
দায়িত্ব ইনশাআল্লাহ আমি সুষ্ঠভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনারা
সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সব
স্থানে অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও কলকারখানাগুলো
পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হন।’
জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী ভাবে সবার অনুরোধে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু দেশের পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি স্বপদে ফিরে যেতে পারেননি; পারেননি দেশের অবস্থার কথা বিবেচনা করে। স্বাধীনতা-উত্তর মানুষের চাওয়া-পাওয়া ছিল অনেক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এসে মানুষকে নিরাশ করেন। তার শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, গুম, হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানি, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, দুঃশাসনের স্টিমরোলার চলতে থাকে। দেশে সেসময় পাঁচ হাজার বিরোধী নেতাকর্মী গুম, সিরাজ শিকদারসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষীবাহিনী কর্তৃক হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রের পথ হয় রুদ্ধ, সৃষ্টি হয় বাকশাল, সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাত্র চারটি পত্রিকা রাখা হয়। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে তার এক সাক্ষাত্কারে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক নির্মল সেন লিখলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছড়াকার আবু সালেহ স্বাধীনতার এক বছর পর লিখলেন, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা। রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা।’ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য আসার পরও লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কবি রফিক আজাদ লিখলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। শেখ মুজিবের একদলীয় দুঃশাসনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় ‘মার্কিন মাসিক রিডার্স ডাইজেস্ট’-এ। ১৯৭৫ সালের মে মাসের সংখ্যায় লেখা হয়—শেখ মুজিব দুটি বেসামরিক সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল—একটি হচ্ছে তার ভাগ্নে শেখ মনি’র ১ লাখ সশস্ত্র একগুঁয়ে যুবকের সংগঠন যুবলীগ, আরেকটি হলো নিষ্ঠুর রক্ষীবাহিনী। তাদের কাজ হলো যখন-তখন কলকারাখানায় ঢুকে পড়ে শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা করে আকস্মিক গ্রামঞ্চলে সান্ধ্য আইন জারি করে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালানো। ওই সময় স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভা এবং দল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। স্বীয় প্রতিশ্রুতি ও নীতি লঙ্ঘন করেন তিনি। এজন্যই দেশজুড়ে ছিল হতাশা আর ক্ষোভ।
দেশ পরিচালনায় দেশের জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। তাই জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ উত্তরণে ১৯৭৭ সালে গণভোট করলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১ কোটি ১০ লাখ ভোটের বিপুল ব্যবধানে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী মোর্চার প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ভোটে পরাজিত ওসমানী পরাজয় মেনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অভিনন্দন জানান। তিনি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন দেন। তার দল বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাত্ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসন লাভ করে।
রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নতুন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার জন্য এ সাধারণ নির্বাচন ছিল প্রথম এক কঠিন পরীক্ষা। তিনি সে কঠিন পরীক্ষায় মহাগৌরবে উত্তীর্ণ হন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের প্রবীণতম রাজনীতিবিদরাও তার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
তার সময় চারটি খবরের কাগজের পরিবর্তে ৪৪৪টি কাগজ চালু হলো। একটি দলের পরিবর্তে শুরু হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র। ৬২টি দল তাদের তত্পরতা শুরু করল। প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য দিলেন ১৯ দফা কর্মসূচি। তিনি লক্ষ্য এবং কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তার অসামান্য মেধা ও শ্রম দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তলাবিহীন ঝুড়িকে পরিণত করলেন ফলপূর্ণ ঝুড়িতে। দেশজুড়ে ১৯ দফার সাড়া পড়ে গেল।
তিনি মনোনিবেশ করলেন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি ডাক দিয়েছেন স্বনির্ভরতার। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সর্বপ্রথম জোর দিলেন খাদ্য উত্পাদনে। বছরে তিনটি ফসল উত্পাদনের জন্য তিনি সারাদেশে উল্কার মতো ছুটে চলতে লাগলেন। তিনি কৃষি উন্নয়নে বিদ্যুত্চালিত সেচ ব্যবস্থা, ট্রাক্টর ও কৃষকের জন্যে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ১২ হাজার খাল পুনর্খনন করেছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। তিনি নিজ হাতে কোদাল ধরেছেন। ১৯৭৯ সালে শুরু হয়ে দু’বছরের মধ্যে ১০১০টি খাল খননের কাজ সমাপ্ত হয়। তিনি সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন। ১৯৮০-৮১ সালে তিনি প্রায় দুই হাজার আটশ’ মাইল দীর্ঘ খাল খননের কাজ হাতে নেয়া হয়েছিল। তিনি কৃষি ও খাদ্যকে দলীয় ও গোষ্ঠীগত রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখুন বলে সবার কাছে অনুরোধ করেন। তার শাসনের আগে এবং প্রথম দিকে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। উত্পাদন বাড়িয়ে ২ বছরের মধ্যে ঘানায় চাল ও চিনি রফতানি করেন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে এ মহান প্রেসিডেন্ট কাজ করেছেন নিরলসভাবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াই প্রথম উপলব্ধি করলেন, নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ নিয়ে কোনো উন্নয়ন তত্পরতা সম্ভব নয়। তাই চালু করলেন গণশিক্ষা। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাপালেন এক কোটি বই। দেড় বছরে ৪০ লাখ বয়স্ক লোক নতুন করে লেখাপড়া শিখলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তিনি গ্রাম এলাকায় ৩৮ হাজার পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োজিত করেন। সৃষ্টি করা হয় এক বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৭ হাজার পল্লী চিকিত্সক। শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রাম সরকার সৃষ্টি করা হলো ৬৫ হাজার গ্রামে। সৃষ্টি করলেন ৮০ লাখ গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মী। প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রশাসন ঢেলে সাজান।
শিল্পক্ষেত্রে উত্পাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি কলকারকানায় তিন শিফটে কাজ শুরু হয় তার আমলে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে দুটি বোনাসের ব্যবস্থা করা হলো। তার সময় মোট জাতীয় উত্পাদন ১৯৮১ সালে শতকরা ৭.৫ ভাগ বাড়ে। অভ্যন্তরীণ উত্পাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
অর্ধশিক্ষিত যুবসমাজকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন জিয়া। জেলায় জেলায় স্থাপিত হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভোকেশনাল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন), যার মাধ্যমেই ট্রেনিং নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকরা চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলছে। সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। শহীদ জিয়া মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, জাতীয় কবির অমর বাণীতে ‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। নারীদের উন্নয়নে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মহিলা সংস্থা। শিশুদের মেধা বিকাশে ১৯৭৭ সালে ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমী। আমাদের স্বকীয় গ্রামীন সংস্কৃতি উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে মাতিয়ে তোলেন গ্রামবাংলা। শিল্পকলা একাডেমীর মতো জেলায় জেলায় শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জনগণের হৃদয়ের মাঝে সুর তুলে দেন, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ। জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ।’
পররাষ্ট্র নীতিতে তিনি ছিলেন সফল। শেখ মুজিব বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অর্জনে ব্যর্থ হন। জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ও চীনসহ বহির্বিশ্বে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ান। এছাড়া তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই প্রাচ্যের সবচেয়ে শিল্পোন্নত ও শক্তিশালী দেশ জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। দেশবাসীর জন্য এটা ছিল এক বিরল সম্মান। প্রেসিডেন্ট জিয়া ইসলামী সম্মেলনে তিন সদস্যবিশিষ্ট ‘আল কুদস’ কমিটির একজন সদস্য হওয়ার দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানের প্রচেষ্টায় ইসলামী সম্মেলনে গঠিত নয় সদস্যের শান্তি মিশনে শীর্ষ নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তার আমলেই সৌদি আরব, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তার আমলে দেশে দেশে মৈত্রীর বিস্তার শুরু হয়। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জিয়া।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার দার্শনিক চিন্তায় বৈপ্লবিক কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ মহিলাদের মাধ্যমে পরিবারের ও দেশের উন্নয়নে ছোট ছোট কুটিরশিল্প, হাঁস, মুরগি, মাছ চাষসহ আঙিনায় আঙিনায় ভরে তুলতে চেয়েছেন বৃক্ষ রোপণ আর মাচাভরা লাউ, কুমড়া, শিম, কাঁকরোল দিয়ে; পুকুর আর খালপাড় গাছে গাছে ভরে তুলতে চেয়েছেন আম, জাম, কাঁঠাল, ডাব, লেবু আর পেঁপে দিয়ে। মাঠের পর মাঠ পেরি ক্ষেতখামার মাড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাসের ২০ দিনেই রাজধানীর বাহিরে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন; দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেছেন; জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা যখন মধ্যে রাতে ঘুমে মগ্ন, তখন ডিসি-এসপিদের মাধ্যমে সরাসরি ফোনে জেলা ও থানা আইনশৃঙ্খলার খোঁজখবর নিতেন। তার ফোনের ভয়ে মন্ত্রী ও ডিসি-এসপিরা তটস্ত থাকতেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের মুখের হাসি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সত্, আদর্শ, মহত্ ও ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী ও নিরহঙ্কার। একজন প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন করতে ভালোবাসতেন। আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রেসিডেন্ট পদের দাবিতে জিয়া সবসময়ই ভালো কাপড় পরতেন। কিন্তু ঘরের ভেতরে তিনি ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে রিপু করে ব্যবহার করতেন।
তার শাহাদাতবরণের পর জাতীয় দৈনিকের বিবরণে জানা যায়, ‘জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো পাওয়া যায় একটা পুরাতন চামড়ার সুটকেসে। তাহা পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ইকোলাক জাতীয় ব্রিফকেস, গায়ের আধা ছেঁড়া গেঞ্জি, ২-৩টি সাফারি শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়ে ছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাহার বিছানার পার্শ্বেই পড়েছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।’ (ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)
বঙ্গবভনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাবারের মেন্যু ছিল—দুপুরে ভাত, রাতে রুটি। ডাল-ভাজি থাকবে। জিয়ার খাবারের আমন্ত্রণকে অনেকে পানিশমেন্ট ফুড হিসেবে বিবেচনা করত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পেয়েছেন অমূল্য উপহার। এসব উপহার এমনকি ব্যক্তিগতভাবে দেয়া উপহারও তিনি নিজে নেননি। এসব জমা দিয়েছেন বঙ্গভবন কোষাগারে। আমরা আমাদের দেশে ডান-বাম রাজনীতিবিদদের দেখেছি বাড়ির ভেতরে রাজকীয় জৌলুসে আর বাইরে মিটিংয়ের মঞ্চে ছেঁড়া পাঞ্জাবির হাত দুলিয়ে বড় বড় স্লোগান। প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতির সঙ্গে হিপোক্র্যাসি করেননি। এ হিপোক্র্যাসি করেননি বলেই জাতির কাছে আজ জিয়া সততার প্রতীক।
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনশৃঙ্খলা ও সার্বিক উন্নয়নে স্বজনপ্রীতির কারণে শেখ মুজিব ব্যর্থ। সেখানে জিয়াউর রহমান মাত্র ৫ বছরের অধিক সময় শাসনামলে শতভাগ সফল—তাই ৩০ মে ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর পর মানিক মিয়া এভিনিউতে ৩০ লাখ মানুষের ঐতিহাসিক জানাজা। জনৈক বিদেশি সাংবাদিক তার সততা সম্পর্কে এক মন্তব্যে বলেছেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সততা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতিকদের জন্যও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত (বাংলাদেশ টাইমস, ৯ নভেম্বর, ১৯৮১)। শহীদ জিয়ার সততার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
ফুটনোট : জিয়াউর রহমানের অমর সৃষ্টি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে জনগণের হৃদয়ের মাঝে ততদিন তার নীতি ও আদর্শ জাগরূক থাকবে । ইতিহাস বিকৃত করে অথবা কোর্টের রায় দিয়ে জনগণের হৃদয়ের মাঝ থেকে প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
জেনারেল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী ভাবে সবার অনুরোধে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু দেশের পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি স্বপদে ফিরে যেতে পারেননি; পারেননি দেশের অবস্থার কথা বিবেচনা করে। স্বাধীনতা-উত্তর মানুষের চাওয়া-পাওয়া ছিল অনেক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় এসে মানুষকে নিরাশ করেন। তার শাসনামলে (১৯৭২-৭৫) সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, গুম, হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানি, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, দুঃশাসনের স্টিমরোলার চলতে থাকে। দেশে সেসময় পাঁচ হাজার বিরোধী নেতাকর্মী গুম, সিরাজ শিকদারসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষীবাহিনী কর্তৃক হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রের পথ হয় রুদ্ধ, সৃষ্টি হয় বাকশাল, সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। মাত্র চারটি পত্রিকা রাখা হয়। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে তার এক সাক্ষাত্কারে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রয়াত স্বনামধন্য সাংবাদিক নির্মল সেন লিখলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছড়াকার আবু সালেহ স্বাধীনতার এক বছর পর লিখলেন, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা। রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা।’ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য আসার পরও লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গেল। তার পরিপ্রেক্ষিতে কবি রফিক আজাদ লিখলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’। শেখ মুজিবের একদলীয় দুঃশাসনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় ‘মার্কিন মাসিক রিডার্স ডাইজেস্ট’-এ। ১৯৭৫ সালের মে মাসের সংখ্যায় লেখা হয়—শেখ মুজিব দুটি বেসামরিক সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল—একটি হচ্ছে তার ভাগ্নে শেখ মনি’র ১ লাখ সশস্ত্র একগুঁয়ে যুবকের সংগঠন যুবলীগ, আরেকটি হলো নিষ্ঠুর রক্ষীবাহিনী। তাদের কাজ হলো যখন-তখন কলকারাখানায় ঢুকে পড়ে শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা করে আকস্মিক গ্রামঞ্চলে সান্ধ্য আইন জারি করে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালানো। ওই সময় স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভা এবং দল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। স্বীয় প্রতিশ্রুতি ও নীতি লঙ্ঘন করেন তিনি। এজন্যই দেশজুড়ে ছিল হতাশা আর ক্ষোভ।
দেশ পরিচালনায় দেশের জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। তাই জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ উত্তরণে ১৯৭৭ সালে গণভোট করলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১ কোটি ১০ লাখ ভোটের বিপুল ব্যবধানে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী মোর্চার প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ভোটে পরাজিত ওসমানী পরাজয় মেনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অভিনন্দন জানান। তিনি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন দেন। তার দল বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাত্ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসন লাভ করে।
রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নতুন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার জন্য এ সাধারণ নির্বাচন ছিল প্রথম এক কঠিন পরীক্ষা। তিনি সে কঠিন পরীক্ষায় মহাগৌরবে উত্তীর্ণ হন। রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের প্রবীণতম রাজনীতিবিদরাও তার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
তার সময় চারটি খবরের কাগজের পরিবর্তে ৪৪৪টি কাগজ চালু হলো। একটি দলের পরিবর্তে শুরু হলো বহুদলীয় গণতন্ত্র। ৬২টি দল তাদের তত্পরতা শুরু করল। প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য দিলেন ১৯ দফা কর্মসূচি। তিনি লক্ষ্য এবং কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তার অসামান্য মেধা ও শ্রম দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তলাবিহীন ঝুড়িকে পরিণত করলেন ফলপূর্ণ ঝুড়িতে। দেশজুড়ে ১৯ দফার সাড়া পড়ে গেল।
তিনি মনোনিবেশ করলেন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি ডাক দিয়েছেন স্বনির্ভরতার। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সর্বপ্রথম জোর দিলেন খাদ্য উত্পাদনে। বছরে তিনটি ফসল উত্পাদনের জন্য তিনি সারাদেশে উল্কার মতো ছুটে চলতে লাগলেন। তিনি কৃষি উন্নয়নে বিদ্যুত্চালিত সেচ ব্যবস্থা, ট্রাক্টর ও কৃষকের জন্যে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ১২ হাজার খাল পুনর্খনন করেছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। তিনি নিজ হাতে কোদাল ধরেছেন। ১৯৭৯ সালে শুরু হয়ে দু’বছরের মধ্যে ১০১০টি খাল খননের কাজ সমাপ্ত হয়। তিনি সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন। ১৯৮০-৮১ সালে তিনি প্রায় দুই হাজার আটশ’ মাইল দীর্ঘ খাল খননের কাজ হাতে নেয়া হয়েছিল। তিনি কৃষি ও খাদ্যকে দলীয় ও গোষ্ঠীগত রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখুন বলে সবার কাছে অনুরোধ করেন। তার শাসনের আগে এবং প্রথম দিকে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। উত্পাদন বাড়িয়ে ২ বছরের মধ্যে ঘানায় চাল ও চিনি রফতানি করেন। দেশ ও জাতির উন্নয়নে এ মহান প্রেসিডেন্ট কাজ করেছেন নিরলসভাবে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াই প্রথম উপলব্ধি করলেন, নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ নিয়ে কোনো উন্নয়ন তত্পরতা সম্ভব নয়। তাই চালু করলেন গণশিক্ষা। নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাপালেন এক কোটি বই। দেড় বছরে ৪০ লাখ বয়স্ক লোক নতুন করে লেখাপড়া শিখলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তিনি গ্রাম এলাকায় ৩৮ হাজার পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োজিত করেন। সৃষ্টি করা হয় এক বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৭ হাজার পল্লী চিকিত্সক। শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রাম সরকার সৃষ্টি করা হলো ৬৫ হাজার গ্রামে। সৃষ্টি করলেন ৮০ লাখ গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মী। প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রশাসন ঢেলে সাজান।
শিল্পক্ষেত্রে উত্পাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি কলকারকানায় তিন শিফটে কাজ শুরু হয় তার আমলে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে দুটি বোনাসের ব্যবস্থা করা হলো। তার সময় মোট জাতীয় উত্পাদন ১৯৮১ সালে শতকরা ৭.৫ ভাগ বাড়ে। অভ্যন্তরীণ উত্পাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
অর্ধশিক্ষিত যুবসমাজকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন জিয়া। জেলায় জেলায় স্থাপিত হয় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভোকেশনাল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন), যার মাধ্যমেই ট্রেনিং নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকরা চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলছে। সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। শহীদ জিয়া মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, জাতীয় কবির অমর বাণীতে ‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। নারীদের উন্নয়নে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মহিলা সংস্থা। শিশুদের মেধা বিকাশে ১৯৭৭ সালে ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন শিশু একাডেমী। আমাদের স্বকীয় গ্রামীন সংস্কৃতি উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে মাতিয়ে তোলেন গ্রামবাংলা। শিল্পকলা একাডেমীর মতো জেলায় জেলায় শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জনগণের হৃদয়ের মাঝে সুর তুলে দেন, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ। জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ।’
পররাষ্ট্র নীতিতে তিনি ছিলেন সফল। শেখ মুজিব বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অর্জনে ব্যর্থ হন। জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ও চীনসহ বহির্বিশ্বে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ান। এছাড়া তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই প্রাচ্যের সবচেয়ে শিল্পোন্নত ও শক্তিশালী দেশ জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। দেশবাসীর জন্য এটা ছিল এক বিরল সম্মান। প্রেসিডেন্ট জিয়া ইসলামী সম্মেলনে তিন সদস্যবিশিষ্ট ‘আল কুদস’ কমিটির একজন সদস্য হওয়ার দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানের প্রচেষ্টায় ইসলামী সম্মেলনে গঠিত নয় সদস্যের শান্তি মিশনে শীর্ষ নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তার আমলেই সৌদি আরব, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তানসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তার আমলে দেশে দেশে মৈত্রীর বিস্তার শুরু হয়। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জিয়া।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার দার্শনিক চিন্তায় বৈপ্লবিক কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ মহিলাদের মাধ্যমে পরিবারের ও দেশের উন্নয়নে ছোট ছোট কুটিরশিল্প, হাঁস, মুরগি, মাছ চাষসহ আঙিনায় আঙিনায় ভরে তুলতে চেয়েছেন বৃক্ষ রোপণ আর মাচাভরা লাউ, কুমড়া, শিম, কাঁকরোল দিয়ে; পুকুর আর খালপাড় গাছে গাছে ভরে তুলতে চেয়েছেন আম, জাম, কাঁঠাল, ডাব, লেবু আর পেঁপে দিয়ে। মাঠের পর মাঠ পেরি ক্ষেতখামার মাড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাসের ২০ দিনেই রাজধানীর বাহিরে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন; দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেছেন; জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা যখন মধ্যে রাতে ঘুমে মগ্ন, তখন ডিসি-এসপিদের মাধ্যমে সরাসরি ফোনে জেলা ও থানা আইনশৃঙ্খলার খোঁজখবর নিতেন। তার ফোনের ভয়ে মন্ত্রী ও ডিসি-এসপিরা তটস্ত থাকতেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের মুখের হাসি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সত্, আদর্শ, মহত্ ও ধার্মিক মানুষ। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী ও নিরহঙ্কার। একজন প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন করতে ভালোবাসতেন। আনুষ্ঠানিকতা এবং প্রেসিডেন্ট পদের দাবিতে জিয়া সবসময়ই ভালো কাপড় পরতেন। কিন্তু ঘরের ভেতরে তিনি ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে রিপু করে ব্যবহার করতেন।
তার শাহাদাতবরণের পর জাতীয় দৈনিকের বিবরণে জানা যায়, ‘জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো পাওয়া যায় একটা পুরাতন চামড়ার সুটকেসে। তাহা পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ইকোলাক জাতীয় ব্রিফকেস, গায়ের আধা ছেঁড়া গেঞ্জি, ২-৩টি সাফারি শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়ে ছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাহার বিছানার পার্শ্বেই পড়েছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।’ (ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)
বঙ্গবভনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাবারের মেন্যু ছিল—দুপুরে ভাত, রাতে রুটি। ডাল-ভাজি থাকবে। জিয়ার খাবারের আমন্ত্রণকে অনেকে পানিশমেন্ট ফুড হিসেবে বিবেচনা করত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি পেয়েছেন অমূল্য উপহার। এসব উপহার এমনকি ব্যক্তিগতভাবে দেয়া উপহারও তিনি নিজে নেননি। এসব জমা দিয়েছেন বঙ্গভবন কোষাগারে। আমরা আমাদের দেশে ডান-বাম রাজনীতিবিদদের দেখেছি বাড়ির ভেতরে রাজকীয় জৌলুসে আর বাইরে মিটিংয়ের মঞ্চে ছেঁড়া পাঞ্জাবির হাত দুলিয়ে বড় বড় স্লোগান। প্রেসিডেন্ট জিয়া জাতির সঙ্গে হিপোক্র্যাসি করেননি। এ হিপোক্র্যাসি করেননি বলেই জাতির কাছে আজ জিয়া সততার প্রতীক।
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনশৃঙ্খলা ও সার্বিক উন্নয়নে স্বজনপ্রীতির কারণে শেখ মুজিব ব্যর্থ। সেখানে জিয়াউর রহমান মাত্র ৫ বছরের অধিক সময় শাসনামলে শতভাগ সফল—তাই ৩০ মে ১৯৮১ সালে তার মৃত্যুর পর মানিক মিয়া এভিনিউতে ৩০ লাখ মানুষের ঐতিহাসিক জানাজা। জনৈক বিদেশি সাংবাদিক তার সততা সম্পর্কে এক মন্তব্যে বলেছেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সততা শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনীতিকদের জন্যও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত (বাংলাদেশ টাইমস, ৯ নভেম্বর, ১৯৮১)। শহীদ জিয়ার সততার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
ফুটনোট : জিয়াউর রহমানের অমর সৃষ্টি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে জনগণের হৃদয়ের মাঝে ততদিন তার নীতি ও আদর্শ জাগরূক থাকবে । ইতিহাস বিকৃত করে অথবা কোর্টের রায় দিয়ে জনগণের হৃদয়ের মাঝ থেকে প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
No comments:
Post a Comment