আরেকটি ১/১১ আসন্ন!
আফজাল
বারী : দেশে ১/১১-এর মতো আরেকটি অসাংবিধানিক সরকার আসন্ন? বড় দুই দলের
হিংসা-বিদ্বেশ, গোয়ার্তুমী আর একগুঁয়েমির কারণে সেই আলামতই দেখতে পাচ্ছেন
বিশিষ্টজন এবং সাধারণ মানুষ। টিভি টক-শোগুলোতে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচকরা এ
আশঙ্কাই প্রকাশ করছেন। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেই তারা
এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কম আশঙ্কা প্রকাশ করছেন না রাজনৈতিক দলের
নেতারাও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধী দল ষডযন্ত্র করে
আরেকটি ১/১১ আনতে চায়। অন্যদিকে উল্টো অভিযোগ বিরোধী দল বিএনপির। দলটির
সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের অভিযোগ সরকারই আরেকটি ১/১১ আনার ষড়যন্ত্র করছে। এর
আগে গণসংযোগকালে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও অভিযোগ করেছেন
সরকার আবারো তাদের সেই আন্দোলনের ফসল ১/১১ আনার ষড়যন্ত্র করছে।
দুই দলের এই পরস্পরবিরোধী অভিযোগ আর একগুঁয়েমি পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞনী ও বুদ্ধিজীবীদের আশঙ্কা চলমান পরিস্থিতি উত্তরণ না ঘটলে ১/১১-এর চেয়ে আরো ভয়াবহ ঘটতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, এম হাফিজ উদ্দিন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ দীন মালিক, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূরুল আমিন বেপারী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমÑ তারাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আর অন্য দলগুলো দোষারূপ করেছে বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকেই। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ইস্যুতে দুই দলের গুয়ার্তুমি পরিস্থিতিকে ১/১১-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বাধ্য করা হয় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে। ভ-ুল করে দেয়া হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, দেশের সুশীল সমাজ এবং জেনারেল মইন-জেনারেল মাসুদ গংয়ের একটি সম্মিলিত প্রয়াস ছিল ১/১১। বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে প্রকাশ্যে দিবালোকে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর উল্লাস করার মতো ভয়ঙ্কর নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সেই লগি-বৈঠার পৈশাচিক ও লোমহর্ষক ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেছে বিশ্বজিৎ হত্যাকা-। পুলিশের সামনেই প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হলো। মিডিয়াতে সেই চিত্র ফলাও করে সচিত্র প্রতিবেদক প্রকাশ করা হলো কিন্তু তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের বদলে ‘উদুর পিন্ডি বুধর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা করেছে। খ-বিখ- বিশ্বজিতের শরীর ময়নাতদন্ত করে নিযুক্ত ডাক্তার মাত্র একটি ক্ষত চিহ্ন দেখালো। এ চিত্র বলে দেয় সরকারের অবস্থা কি? প্রতিনিয়ত হত্যা, গুমের তালিকায় ১৫৪, অপহরণ অনেক, দখল, অগ্নিসংযোগ, শিক্ষাঙ্গনে উঁচিয়ে গুলি বর্ষণ, শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, মরিচের গুঁড়া ¯েপ্র, দেশের ইতিহাসে বিরোধী দলের মহাসচিবকে দফায় দফায় গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন, পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডার সম্মিলিতভাবে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলাসহ সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের তা-বলীলা দেশজুড়ে এক নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাই এখন মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মানুষ বাঁচতে চায়। একই সাথে দেশ পরিচালনাকারী ও সরকারের বিরোধিতাকারী দুই রাজনৈতিক দলের কাছেই তারা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান চায়।
গত বৃহস্পতিবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গণতন্ত্র নস্যাতের চেষ্টায় বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়কের নামে আবার এক-এগারো আনার চেষ্টা করছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে এই আন্দোলন করছে। সরকারের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে গতকাল দেয়া ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মাইনাস টু’র ফর্মুলা প্রবক্তারা এখনো সক্রিয়। মাঝেমধ্যে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়।
প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগের উল্টো অভিযোগ বিএনপির প্রধান সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের। গতকাল তিনি বলেছেন, বিরোধী দল নয়, সরকারই ভোটের অধিকার হরণ করে আরেকটি এক-এগারো আনার ষড়যন্ত্র করছে। ১/১১ সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে তিনি বলেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী ১/১১-এর পর বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন সাহেবদের সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি (শেখ হাসিনা) উপস্থিত ছিলেন। ফখরুদ্দীন আহমেদকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ১/১১ সৃষ্টি সঙ্গে জড়িত সেনাসমর্থিত সরকারের তৎকালীন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এখনো অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই সরকারের সঙ্গে সখ্যতা না থাকলে কীভাবে তিনি ওই পদে বহাল থাকেনÑ এমন প্রশ্ন ছুড়েছেন তিনি। এর আগে ২৬ নভেম্বর ১৮ দলের গণসংযোগ কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াও অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ আবারো অবৈধ সরকার আনার অপচেষ্টা করছে।
জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এ প্রসঙ্গে বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের প্রবক্তা শাসক দল আওয়ামী লীগ। বর্তমানের সকল অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী কর্মকা-ের বৈধতা পেতেই আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে সরকার। আমরা কখনোই সংঘাত চাইনি, এখনো চাই না। সংলাপের মাধ্যমে সরকার সৃষ্ট সমস্যার সমাধান চাই।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যে পরিস্থিতির কারণে ১/১১ এসেছিলো আমরা সেই চিত্রের অবতারণা দেখতে পাচ্ছি। দেশ পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা তাদের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটানো। আর চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষকে এই দুই দলের গোয়ার্তুমির কারণে মাশুল দিতে হবে। আরো ভয়াবহ ঘটনার অবতারণা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আরেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান সেই গতানুগতিক রাজনৈতিক চর্চা করছেন। গত ১/১১-এর জন্য দায়ী ছিলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এবারও তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেÑ জাতি কার কথা বিশ্বাস করবে। আমরা মনে করি দেশে এখনো শক্তিশালী রাজনৈতিক তৃতীয় কোনো দল নেই। ভবিষ্যতে ১/১১ বা অন্য কোনো সরকারের উদ্ভব হলে তার জন্য এই দুই দলই দায়ী থাকবে। বর্তমানের পরিস্থিতি আমাদের সেই ২০০৭ সালের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সংলাপ বা আলোচনা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমসহ টিভি টক-শোর আলোচকদের বেশিরভাগই আরেকটি অপ্রত্যাশিত অর্থাৎ ১/১১-এর মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূরুল আমিন বেপারি মনে করেন, শুধু দেশের বুদ্ধিজীবী, দুই নেত্রী বা সুশীল সমাজেরই নয়, বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যেও ১/১১-র আশঙ্কা জন্ম দিয়েছে। ১/১১ আসার জন্য যেমন আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার আন্দোলন করেছিলো, তেমনি বিএনপিও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়নি। ওই সময় যে পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলোÑ এখনো সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। তাই চলমান পরিস্থিতিতে আরেকটি ১/১১ বা ২/২২ আসতে পারে। বিদেশী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ওই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। আর এই পরিস্থিরি সৃষ্টি হলে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই দুই দলের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ দীন মালিক মনে করেন, বর্তমান সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারই হবে অসাংবিধানিক ও অবৈধ। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে ১/১১-এর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তারা যদি মনে করেন অতলে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে তাহলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেন। একই সঙ্গে এই আইন বিশারদ বলেন, সাধারণ মানুষ ষড়যন্ত্রের কথা বললে কিছু যায় আসে না, কিন্তু শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্রের কথা বললে জনগণ আতঙ্কিত হয়। এটা না করই উচিত।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমীর প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সরকার ও বিরোধী দল যে অবস্থা নিয়েছে তাতে সংঘাত অনিবার্য। এতে করে জনগণের জানমাল ক্ষতি ঘটবে। এর দায় দায়ভার উভয় দলের নেত্রীকেই বহন করতে হবে। এ পথ পরিহার করে পরস্পরকে ছাড় দিয়ে আলোচনার জন্য অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বদলীয় সংলাপ নিতে হবে। নয়তো কাউকে ক্ষমা করবে না।
বাংলাদেশ তরিকত ফেড়ারেশন ও প্রগতিশীল ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আলহাজ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, দুই জোটের দুই নেত্রীর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই দেম ক্রমেই সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মানুষের জানমালের ক্ষতি হয়েছে, আগামীতে আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এজন্য বড় দুই দলই সমভাবে দায়ী হবে বলে তার মত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে আলোচনায় বসা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধিত সকল দলকে নিয়ে আলোচনার উপর তাগিদ দেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহম্মেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী অনড় অবস্থানে রাজনীতিকে সংঘাতময় করে তুলেছে। এরপরেও তারা কাঁদা ছোড়াছুড়ি করেছে। এতে দেশের জনগণের জানামালের ধ্বংসের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য দেশ ও বিদেশ থেকে নানামুখী পরামর্শ এলেও তারা তা কর্ণপাত করছেন না। বিকল্প সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য নিবন্ধিত সকল দলের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা দুই দলের নেত্রীর উচিত।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দুই নেত্রী অনড় অবস্থানের কারণে দেশে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং রাজনীতি ক্রমেই সংঘাতময় হচ্ছে। সংলাপের মাধ্যমে এর উপায় বের করতে হবে। নয়তো জাতি মহাসঙ্কটে পড়বে এর জন্য দায়ী হতে হবে দুই দলকেই। আর সংলাপের জন্য দুই নেত্রীকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সকল দলকে ডেকে উপায় বের করতে হবে।
দুই দলের এই পরস্পরবিরোধী অভিযোগ আর একগুঁয়েমি পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞনী ও বুদ্ধিজীবীদের আশঙ্কা চলমান পরিস্থিতি উত্তরণ না ঘটলে ১/১১-এর চেয়ে আরো ভয়াবহ ঘটতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, এম হাফিজ উদ্দিন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ দীন মালিক, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূরুল আমিন বেপারী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমÑ তারাও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আর অন্য দলগুলো দোষারূপ করেছে বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকেই। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ইস্যুতে দুই দলের গুয়ার্তুমি পরিস্থিতিকে ১/১১-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বাধ্য করা হয় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে। ভ-ুল করে দেয়া হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, দেশের সুশীল সমাজ এবং জেনারেল মইন-জেনারেল মাসুদ গংয়ের একটি সম্মিলিত প্রয়াস ছিল ১/১১। বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে রাজপথে প্রকাশ্যে দিবালোকে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর উল্লাস করার মতো ভয়ঙ্কর নানা ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সেই লগি-বৈঠার পৈশাচিক ও লোমহর্ষক ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেছে বিশ্বজিৎ হত্যাকা-। পুলিশের সামনেই প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হলো। মিডিয়াতে সেই চিত্র ফলাও করে সচিত্র প্রতিবেদক প্রকাশ করা হলো কিন্তু তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের বদলে ‘উদুর পিন্ডি বুধর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা করেছে। খ-বিখ- বিশ্বজিতের শরীর ময়নাতদন্ত করে নিযুক্ত ডাক্তার মাত্র একটি ক্ষত চিহ্ন দেখালো। এ চিত্র বলে দেয় সরকারের অবস্থা কি? প্রতিনিয়ত হত্যা, গুমের তালিকায় ১৫৪, অপহরণ অনেক, দখল, অগ্নিসংযোগ, শিক্ষাঙ্গনে উঁচিয়ে গুলি বর্ষণ, শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, মরিচের গুঁড়া ¯েপ্র, দেশের ইতিহাসে বিরোধী দলের মহাসচিবকে দফায় দফায় গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদন, পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডার সম্মিলিতভাবে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে হামলাসহ সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের তা-বলীলা দেশজুড়ে এক নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটাই এখন মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মানুষ বাঁচতে চায়। একই সাথে দেশ পরিচালনাকারী ও সরকারের বিরোধিতাকারী দুই রাজনৈতিক দলের কাছেই তারা সংলাপের মাধ্যমে সমাধান চায়।
গত বৃহস্পতিবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গণতন্ত্র নস্যাতের চেষ্টায় বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়কের নামে আবার এক-এগারো আনার চেষ্টা করছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে এই আন্দোলন করছে। সরকারের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে গতকাল দেয়া ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মাইনাস টু’র ফর্মুলা প্রবক্তারা এখনো সক্রিয়। মাঝেমধ্যে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়।
প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগের উল্টো অভিযোগ বিএনপির প্রধান সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের। গতকাল তিনি বলেছেন, বিরোধী দল নয়, সরকারই ভোটের অধিকার হরণ করে আরেকটি এক-এগারো আনার ষড়যন্ত্র করছে। ১/১১ সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে তিনি বলেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী ১/১১-এর পর বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন সাহেবদের সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি (শেখ হাসিনা) উপস্থিত ছিলেন। ফখরুদ্দীন আহমেদকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ১/১১ সৃষ্টি সঙ্গে জড়িত সেনাসমর্থিত সরকারের তৎকালীন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এখনো অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই সরকারের সঙ্গে সখ্যতা না থাকলে কীভাবে তিনি ওই পদে বহাল থাকেনÑ এমন প্রশ্ন ছুড়েছেন তিনি। এর আগে ২৬ নভেম্বর ১৮ দলের গণসংযোগ কর্মসূচিতে বক্তৃতাকালে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াও অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ আবারো অবৈধ সরকার আনার অপচেষ্টা করছে।
জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এ প্রসঙ্গে বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের প্রবক্তা শাসক দল আওয়ামী লীগ। বর্তমানের সকল অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী কর্মকা-ের বৈধতা পেতেই আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির সকল ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে সরকার। আমরা কখনোই সংঘাত চাইনি, এখনো চাই না। সংলাপের মাধ্যমে সরকার সৃষ্ট সমস্যার সমাধান চাই।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যে পরিস্থিতির কারণে ১/১১ এসেছিলো আমরা সেই চিত্রের অবতারণা দেখতে পাচ্ছি। দেশ পরিচালনা করেন রাজনীতিবিদরা তাদের উচিত হবে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটানো। আর চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষকে এই দুই দলের গোয়ার্তুমির কারণে মাশুল দিতে হবে। আরো ভয়াবহ ঘটনার অবতারণা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আরেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান সেই গতানুগতিক রাজনৈতিক চর্চা করছেন। গত ১/১১-এর জন্য দায়ী ছিলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এবারও তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেÑ জাতি কার কথা বিশ্বাস করবে। আমরা মনে করি দেশে এখনো শক্তিশালী রাজনৈতিক তৃতীয় কোনো দল নেই। ভবিষ্যতে ১/১১ বা অন্য কোনো সরকারের উদ্ভব হলে তার জন্য এই দুই দলই দায়ী থাকবে। বর্তমানের পরিস্থিতি আমাদের সেই ২০০৭ সালের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সংলাপ বা আলোচনা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিমসহ টিভি টক-শোর আলোচকদের বেশিরভাগই আরেকটি অপ্রত্যাশিত অর্থাৎ ১/১১-এর মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নূরুল আমিন বেপারি মনে করেন, শুধু দেশের বুদ্ধিজীবী, দুই নেত্রী বা সুশীল সমাজেরই নয়, বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যেও ১/১১-র আশঙ্কা জন্ম দিয়েছে। ১/১১ আসার জন্য যেমন আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠার আন্দোলন করেছিলো, তেমনি বিএনপিও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়নি। ওই সময় যে পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলোÑ এখনো সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। তাই চলমান পরিস্থিতিতে আরেকটি ১/১১ বা ২/২২ আসতে পারে। বিদেশী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ওই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। আর এই পরিস্থিরি সৃষ্টি হলে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই দুই দলের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ দীন মালিক মনে করেন, বর্তমান সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকার ছাড়া অন্য কোনো সরকারই হবে অসাংবিধানিক ও অবৈধ। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে ১/১১-এর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তারা যদি মনে করেন অতলে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে তাহলে তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারেন। একই সঙ্গে এই আইন বিশারদ বলেন, সাধারণ মানুষ ষড়যন্ত্রের কথা বললে কিছু যায় আসে না, কিন্তু শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্রের কথা বললে জনগণ আতঙ্কিত হয়। এটা না করই উচিত।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমীর প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সরকার ও বিরোধী দল যে অবস্থা নিয়েছে তাতে সংঘাত অনিবার্য। এতে করে জনগণের জানমাল ক্ষতি ঘটবে। এর দায় দায়ভার উভয় দলের নেত্রীকেই বহন করতে হবে। এ পথ পরিহার করে পরস্পরকে ছাড় দিয়ে আলোচনার জন্য অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বদলীয় সংলাপ নিতে হবে। নয়তো কাউকে ক্ষমা করবে না।
বাংলাদেশ তরিকত ফেড়ারেশন ও প্রগতিশীল ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আলহাজ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, দুই জোটের দুই নেত্রীর পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই দেম ক্রমেই সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মানুষের জানমালের ক্ষতি হয়েছে, আগামীতে আরো ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এজন্য বড় দুই দলই সমভাবে দায়ী হবে বলে তার মত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে আলোচনায় বসা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধিত সকল দলকে নিয়ে আলোচনার উপর তাগিদ দেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহম্মেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী অনড় অবস্থানে রাজনীতিকে সংঘাতময় করে তুলেছে। এরপরেও তারা কাঁদা ছোড়াছুড়ি করেছে। এতে দেশের জনগণের জানামালের ধ্বংসের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য দেশ ও বিদেশ থেকে নানামুখী পরামর্শ এলেও তারা তা কর্ণপাত করছেন না। বিকল্প সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য নিবন্ধিত সকল দলের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা দুই দলের নেত্রীর উচিত।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দুই নেত্রী অনড় অবস্থানের কারণে দেশে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং রাজনীতি ক্রমেই সংঘাতময় হচ্ছে। সংলাপের মাধ্যমে এর উপায় বের করতে হবে। নয়তো জাতি মহাসঙ্কটে পড়বে এর জন্য দায়ী হতে হবে দুই দলকেই। আর সংলাপের জন্য দুই নেত্রীকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সকল দলকে ডেকে উপায় বের করতে হবে।
No comments:
Post a Comment