Thursday, December 27, 2012

পরকীয়ার স্বরূপ ও বর্তমান পরিস্থিতি

পরকীয়ার স্বরূপ ও বর্তমান পরিস্থিতি
-আবু বকর সিরাজী
কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় বেইজ লাইন সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পরকীয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ষাটদশকের তুলনায় এই প্রবণতা অনেক বেশি। সে সময়েও পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল না। বর্তমানে প্রতি দশজন পুরুষের মধ্যে তিনজন পুরুষ পরকীয়ায় জড়িত।
সত্যিকার অর্থেই একটি উদ্বেগজনক রিপোর্টই বটে। এই রিপোর্টটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সীমাহীন দৈন্যের পথনির্দেশ করে। আসলে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা মাত্র ৫০ বছর পিছিয়ে গিয়েছেন। যদি আরও কয়েকশ বছর পিছিয়ে খোলাফা বা ইসলামের শাসনযুগের কাছে ফিরে যেতেন, তাহলে চিত্রটা আরেকটু ভিন্ন দেখতেন। তখন তফাৎটা আরেকটু মোটা দাগে ধরা পড়ত।
যাহোক, পত্রিকা এই রিপোর্ট প্রকাশ করার পর এ সংক্রান্ত অনেকগুলো ঘটনা তুলে ধরেছে। আমরা দুয়েকটি ঘটনা তুলে ধরার আগে পরকীয়ার স্বরূপ তুলে ধরার প্রয়াস পাবো, ইনশাআল্লাহ।
ইবন মুকাফফা(রহ.) পরনারীর প্রতি আসক্ত হওয়ার কারণ ও তার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, শয়তান পরনারী সম্পর্কে মানুষের অন্তরে স্বাদ জুগিয়ে দেয়। তাদের কল্পনাটাই তার কাছে মধুময় হয়ে ওঠে। চোখ ও অন্তরে তাদের সৌন্দর্য সুশোভিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বস্তুত এটা এক ধরনের প্রতারণা ও ধোঁকা। কেননা, নিজের বৈধ স্ত্রী কিংবা স্বামীর বদলায় যার দিকে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, সে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের স্বামী বা স্ত্রীর চেয়ে নিম্নমানের হয়ে থাকে।[আল-আদাবুল কাবীর পৃ. ৯৯]
ইবন মুফলিহ হাম্বলী রহ. পরকীয়ার স্বরূপ আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, বুদ্ধিমান ব্যক্তির অন্য নারীদের দিকে তাকানো থেকে নিজের চোখকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত। কেননা, মানুষ নিজের বৈধ বস্তু (স্ত্রী বা স্বামী)-র চেয়ে অবৈধ বস্তু তথা পরকীয়ার নারী-পুরুষকে বেশি সৌন্দর্যের দৃষ্টিতে দেখে।
তুমি তাকে দেখবে সৌন্দর্যের দৃষ্টিতে, তার কথাগুলো কানে বাজবে সুরেলা স্বরে, সামাজিকভাবে তাকে বেশি ফিট ও উপযোগী মনে হবে, অন্তরঙ্গতায় মনে হবে সেরা, আনন্দ প্রদানে মনে হবে শ্রেষ্ঠ। এই মনে করাটা তোমাকে তোমার বৈধ স্ত্রী বা স্বামী থেকে মন কেড়ে নিয়ে অবৈধ স্থানে পতিত করবে। তোমার চোখে শয়তান ধাঁধাঁ সৃষ্টি করবে, হালালের প্রতি তোমার মধ্যে অনীহা ভাব সৃষ্টি করবে, বৈধ বস্তুর প্রতি ঘৃণা ও অবৈধ বস্তুর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করবে। কারণ, মানুষের মধ্যে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। শয়তান এই প্রবণতাকে কাজে লাগায়। নিজের কাছে হালাল যে বস্তু আছে তাতে অনীহা ও অরুচি ধরিয়ে দেয়। সর্বোপরি শয়তানের প্রধান কাজ হলো তোমার কাছে, যে হালাল বস্তু সংরক্ষিত আছে, তার চেয়ে যা তোমার কাছে নেই তথা তোমার জন্য যা হারাম তাকে তোমার দৃষ্টিতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে পেশ করা।
এর ফলে তার প্রতি তোমার ইশ্ক-প্রেম সৃষ্টি হয়। ফলে ধ্বংস হয় দ্বীন-দুনিয়া সবই। কত দৃষ্টি যে এই ধ্বংসলীলা সাধন করেছে! কত দৃষ্টি যে কত জনপদ, পরিবার ও সমাজকে এভাবে ধ্বংস করেছে!
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ইবন মুবারক (রহ.) বর্ণনা করতেন, যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে নিজে থেকেই ফিতনা (পরকীয়া-প্রেম) জন্ম দেবে, সে কখনও তা থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। যদিও সে এর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে।আর এটা সৃষ্টি হয় অনৈতিক মেলামেশা ও বেপর্দার কারণে। [আলফুরূ‘ : /১৫৫] (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
এর প্রমাণস্বরূপ একটি বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ ঘটনা পেশ করা যেতে পারে।
দৃষ্টির উদারতা, বাধাহীনতা ও অবৈধ পাত্রে তা ব্যবহার করার অপকারিতার চিরস্মরণীয় একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এই ঘটনাটি।
হিন্দ বিনতে খুস ইয়াদিয়া জাহেলী যুগের একজন প্রসিদ্ধ জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহিত্যিক ও প্রখর মেধার অধিকারী একজন ধনবতী নারী ছিলেন। কিন্তু তিনিই অবিশ্বাস্যভাবে তার এক ভৃত্যের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। অথচ তিনি আরব দুনিয়ার একজন নামকরা জ্ঞানী হওয়ায় এর কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। তাকে এই অবিশ্বাস্য কান্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি আরবজাহানের একজন প্রসিদ্ধ জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে একজন দাসের সঙ্গে অপকর্মে লিপ্ত হতে পারলেন? তিনি জবাবে বললেন- দুটি বিষয় আমাকে একাজে জড়িয়ে পড়া সহজ করেছে। এক. পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া। দুই. পরপুরুষের সঙ্গে কথাবার্তা, গল্পচারিতা ও খোশালাপ।
অর্থাৎ- এই দুটি বিষয় এমন পাপ, যা বুদ্ধিমতী ও আরবখ্যাত একজন নারীকে আস্তে-আস্তে তার শরাফত, আভিজাত্য, সতীত্ব, নেতৃত্ব ও সম্ভ্রমের গণ্ডি থেকে বের করে এনে ব্যভিচারের মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত করে দিয়েছিল। বস্তুত দৃষ্টির উদারতা ও অনৈতিক মেলামেশাই একজন নারী বা পুরুষকে প্রেম বা পরকীয়ার মতো ভয়ানক পাপে লিপ্ত করে দেয়। দৃষ্টি হলো শয়তানের একটি তীর। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
اَلنَّظْرُ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ اِبْلِيْسَ -
দৃষ্টি হলো শয়তানের তীরসমূহের একটি।’ [মুস্তাদরাক হাকেম : /৩১৪8]
অতএব, একজন নারী বা পুরুষকে অবশ্যই শয়তানের এই তীরের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে হবে। আর মেলামেশা থেকে তো বেঁচে থাকতে হবেই। জনৈক কবি বলেন-
اِنَّ السَّلاَمَةَ مِنْ سَلْمٰى وَجَارِتِهَا  اَنْ لاَ تَمُرَّ عَلَى حَالِ بِوَادِيْهَا
সালমা ও তার অনুরূপ নারীদের (প্রেমিকদের) হাত থেকে বাঁচার নিরাপদ পন্থা একটাই। তাহলো, তার বসবাসের উপত্যকা কখনও না মাড়ানো।’
সত্যি কথা কী, আমাদের সমাজ এই মারাত্মক দুটি অপরাধে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত। একারণে প্রেম ও পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবল আমাদের আকাশ- বাতাসকে ভারি করে তুলেছে। রিপোর্টটি উল্লেখ করার পর পত্রিকাটি কয়েকটি পরকীয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছে। এখানে দুয়েকটি তুলে ধরা হলো।
ঘটনা-: যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকার হতভাগা লোকটির নাম ওবায়দুল হক। বয়স ৩৫। দনিয়া বাজারের ৫৭৬, সাত্তার সর্দার রোডের বাসিন্দা। আল্লাহপ্রদত্ত ও পৈত্রিক জীবনটা তার ছিন্নভিন্ন আর রক্তাক্ত হয়েছে স্ত্রীর পরকীয়ার বিষাক্ত ছোরায়। স্ত্রী নাসিমা বেগম লাবলু নামের এক যুবকের সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরকীয়ার পথে সবচে বাধা যে স্বামী! তাই পরকীয়ার প্রথম কোপটা পড়ল ওবায়দুলের ওপর। স্ত্রী নাসিমা আর তার প্রেমিক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ। ৪ঠা জানুয়ারী স্ত্রী নাসিমা ও তার প্রেমিক লাবলু তাকে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার মাথার পেছনে ও ঘাড়ে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ ৪ জানুয়ারি ২০১১ ইং]
ঘটনা-: এ ঘটনা নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের। পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে এবার প্রাণ হারিয়েছেন স্বামী ও স্ত্রীর ফুফাতো ভাই। গুণে-গুণে দুই দুইজন মানুষ! ঘটনাটি হচ্ছে : রাশেদা বেগম নামের এক মহিলাকে শুক্কুর আলী নামের এক যুবকের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন রাশেদার ফুফাতো ভাই সামসুল ইসলাম। এরপর থেকে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। বহু খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায় নি কোথায়ও। অবশেষে কয়েকদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় পাশের এক পুকুরে। হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পুলিশ রাশেদার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাকে ছেড়ে দিলেও সে মারাত্মক অপমানবোধ করে এবং এ কারণে আত্মহত্যা করে।
ধারণা করা হয়, রাশেদাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখাই কাল হয় শামসুল ইসলামের জন্য। পরকীয়ার পাপ দেখার অপরাধী চোখ’ আর মুখের ভাষা চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার জন্য রাশেদা ও তার পরকীয়া প্রেমিক তাকে দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়। এদিকে স্বামীর নিজের বধূকে অন্যের বাহুলগ্না অবস্থায় দেখার অপমানের সঙ্গে যোগ হয় তাকে জেরা করার অপমান। এ দুয়ে মিলে সেও বেছে নেয় পরকালের পথ। একটি পরকীয়া এভাবেই কেড়ে নেয় দুটি তাজা প্রাণ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
«بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيبًا، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا »
ইসলাম একাকিত্ব নিয়ে শুরু হয়েছিল এবং অতিসত্বর ইসলাম একাকিত্বের দিকেই ফিরে যাবে।’ [মুসলিম : ১৪৫]
অর্থাৎ ইসলামের সূচনা হয়েছিল নিঃসঙ্গতা নিয়ে, অল্প কিছু মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক তদ্রূপ আবার আগের সেই অবস্থা ফিরে আসবে। মানুষ দ্রুতবেগে ইসলামের সীমানা থেকে দূরে সরে যেতে চাইবে। ইসলামের আদর্শ, ইসলামের মহত্ব তাদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় মনে হবে। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হবে। দুনিয়াব্যাপী এক আওয়াজ উঠবে- অশান্তি।
আজ কী হচ্ছে না তা-ই বলুন! বেপর্দা, প্রেম আর পরকীয়ার কথাই ধরুন। এসব কারণে শুধু আমাদের দেশই নয় সারাবিশ্ব অস্থিরতা আর অশান্তির চোরাবালিতে আটকে গেছে। ঘটছে লোমহর্ষক যতসব ঘটনা।
৮ জানুয়ারি একটি পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, পরকীয়ায় পুরুষও নির্যাতিত। পুরুষরা স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। একে কেন্দ্র করে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে ব্যাপকভাবে। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এলেও অধিকাংশ ঘটনা থেকে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে।

No comments:

Post a Comment