মজলুম জনতার নেতা
রিটিশ ভারতে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন, আজাদী আন্দোলন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ২১ দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯-এর
গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন, ফারাক্কা মিছিল,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বাংলা খুতবা ও হক কথার প্রকাশ, খোদায়ী
খিদমতগার প্রতিষ্ঠাসহ অনেক আন্দোলনের এক প্রাণপুরুষের নাম মওলানা আবদুল
হামিদ খান ভাসানি।
১৮৮০
সালে সিরাজগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মওলানা
ভাসানী। ছোটবেলায় ধানগড়া প্রইমারি স্কুলে তিনি কিছুকাল পড়ালেখা করেন।
কিন্তু গতানুগতিক লেখাপড়ায় তার আগ্রহ ছিল খুবই কম। তাই লেখাপড়া ছেড়ে তিনি
কিছুকাল লাঠিখেলা ও কুস্তি নিয়ে মত্ত থাকেন। পরে কবিগান শুনতে শুনতে তিনি
কবিয়ালও হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে চলাফেরা ছিল খুবই সাধারণ বিলাসীতাহীন।
গায়ে পাঞ্জাবি, পরনে লুঙ্গি, মাথায় গোল টুপি আর হাতে থাকত বেতের লাঠি।
সারাটা জীবনই তিনি নিজের কথা চিন্তা না করে অন্য মানুষের দুঃখে কেঁদেছেন,
সংগ্রাম করেছেন। ১৯১৯ সালে উপমহাদেশে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে
তিনি এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আন্দোলন তার সামনে নতুন দিগন্তের সূচনা
করে। তিনি এই আন্দেলনের মাধ্যমে মওলানা মুহাম্মদ আলী, শওকত আলী, আবুল কালাম
আজাদ, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহেরু, সুভাষ বোস প্রমুখ
সর্বভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৩৬ থেকে প্রায় সুদীর্ঘ ১০ বছর
পর্যন্ত লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন করেন মওলানা ভাসানী। বাঙ্গাল খেদাও বলে
আসামের জমিদাররা কৃষকদের ওপর চালায় নির্মম অত্যাচার। আসামের উচ্ছেদকৃত
বাস্তুহারা কৃষকদের কাছে মওলানা ভাসানী আবিষ্কৃত হয়েছিলেন ত্রাণকর্তারূপে।
এসব কৃষকের পরম দুর্দশার দিনগুলোতে সুদূর বাংলা থেকে কোনো বড় নেতা তাদের
হয়ে আসামে সংগ্রাম করতে যাননি। ১৯৪২ সালে লাইন প্রথা ভাঙার শপথ নিয়ে
ভাসানচরে এক কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন, সেখান থেকেই তার নামের সঙ্গে ‘ভাসানী’ যুক্ত হয়। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার রায়পুরার শিবপুরে তিনি প্রথম কৃষক সম্মেলন করেন। তার মুখে স্লোগান ছিল— কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না। তিনি বলেছিলেন—‘আমি
শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলব, কৃষক, মজুর, জেলে-জোলা, কামার-কুমার শোষিত নিয়ে
আমি শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করব, প্রত্যক্ষ বিপ্লবের মাধ্যমে আমি শ্রেণীহীন,
শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলব।’
মওলানা ভাসানী ১৯৩৬ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে মুসলিম লীগে
যোগদান করেন। মুসলিম লীগে যোগদানের পর মওলানা ভাসানী অনায়াসেই নেতৃত্বের
প্রথম কাতারে চলে আসেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানকে অপসারণের পর
টাইম পত্রিকা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দিয়ে লিখেছিল—আকণ্ঠ
বিস্তৃত শ্মশ্রু এই মানুষটির উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে স্বর্গীয় প্রশান্তির ছাপ।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা থেকে ষাট মাইল দূরে তিনি নাতি-নাতনিদের
কাছে যেমনি মোহপরায়ণ এক খেলার সাথী, তেমনি দেশের লাখ লাখ বাঙালি কৃষকের
কাছে এই ৮৬ বছর বয়স্ক আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রাণের হুজুর। টাইম পত্রিকার
সাংবাদিক ডান কোগিনকে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন—‘আমার দেশবাসীর জন্য আমি ফাঁসিতে ঝুলতেও প্রস্তুত।’
তিনি রাজপথের আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৯ জানুয়ারি সন্তোষের
আসাদনগরে বলেন, যে পন্থায় ভারত থেকে পাকিস্তান আলাদা হয়েছে, সেই একই পন্থায়
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ আলাদা হবে। ফারাক্কা
বাঁধের প্রতিবাদে তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে এক বিশাল লংমার্চের আয়োজন করেন। দু’দিনে
১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ১৭ মে রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে
শেষ হয়। সেখানে তিনি বলেন, গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার
ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমাদের অন্দোলন।
আমি জানি এখানেই শেষ নয়...। ঠিক তাই, সেখানেই শেষ হয়নি, আজও আমাদের
ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে লড়াই করতে হচ্ছে। মওলানা আবদুল হামিদ
খান ভাসানী ১৯৭৭ সালে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন আহ্বানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ
সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্বে তিনি বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মুহম্মদ আলীকে
নিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে সফরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এ
স্বপ্ন পূরণ হয়নি, তার আগেই ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর পরপারে পাড়ি জমান। তার
সেই চলে যাওয়া আমরা আজও ভুলিনি, কোনোদিন ভুলব না।
No comments:
Post a Comment