পাকিস্তানের
রাজধানী ইসলামাবাদে ২১ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত
আত্মজীবনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। সেখানে বক্তব্য দেন পাকিস্তানের জিয়ো
টেলিভিশনের নির্বাহী সম্পাদক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক হামিদ মির। প্রথম আলোর
পাঠকদের জন্য তাঁর সেই বক্তব্য তুলে ধরা হলো:
অনেক পাকিস্তানির কাছে শেখ মুজিবুর রহমান একজন খলনায়ক। একপেশে ইতিহাসের বই বলছে, মুজিব ছিলেন বিশ্বাসঘাতক; তিনি ভারতের মদদ নিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙে দুই ভাগ করেছিলেন। আমাদের ইতিহাসের বইগুলো পড়ে আমরা জেনেছি, ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই ঢাকাতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে (প্রকৃতপক্ষে তারা আত্মসমর্পণ করেছিল বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে) আত্মসমর্পণ করেছিল, সে কথা আমরা জানি না। আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা দিয়ে ইতিহাসের কলঙ্ক ঢাকার চেষ্টা করেছি; শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী (দি আনফিনিশড মেমোয়ার) আমাদের স্কুল-কলেজে পাঠ্য সব দাপ্তরিক ইতিহাসের বইকে বাতিল করে দিয়েছে।
এই আত্মজীবনীতে পরিষ্কার হয়েছে, বিশ্বাসঘাতক মুজিব স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায়ই পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্মৃতিকথায় তিনি নিজের সম্বন্ধে সত্য ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৩৯ সালে নিজ শহর গোপালগঞ্জে মুসলিম লিগের যাত্রা শুরুর বিষয়ে তিনি যে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন, সে কথা তিনি চেপে যাননি। অধিকন্তু, মুজিব একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন, বাঙালি নেতা ফজলুল হক ১৯৪১ সালে যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেছিলেন, তখন মুসলিম লিগ ওই সময় ফজলুল হকের বিরোধিতা করে প্রচারণা শুরু করে। শেখ মুজিব নিজে সেই প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হকের সঙ্গে ছিলেন না; পরিষ্কারভাবে ছিলেন জিন্নাহপন্থী। ওই সময় মুসলিম লিগের যেসব তরুণ কর্মী ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানপন্থী সাপ্তাহিক মিল্লাত বিক্রি করে বেড়াতেন, মুজিব ছিলেন তাঁদেরই একজন।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো সেটি হলো, জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের আমলে কারাবন্দী থাকার সময় শেখ মুজিবুর রহমান এই বইটি লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন খুব সততার সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অসততা উন্মোচন করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, একটি পর্যায়ে এসে তিনি মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে কংগ্রেস পার্টির চালানো কর্মকাণ্ডে গোপনে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু একজন সামরিক একনায়কের জেলে বন্দী থেকেও তিনি ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির মন জয়ের চেষ্টা করেননি।
১৯৪৭ ও ১৯৫৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পূর্ণ হয়ে ওঠা পাকিস্তানের রাজনীতির একটি অভূতপূর্ব দলিল এই বই। আমি মনে করি, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই বই সত্যিকার ইতিহাসের একটি অনন্য উৎস। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, বইটিতে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। মুজিব লিখেছেন, একদিন তিনি কয়েক শ হিন্দুকে একটি মসজিদে হামলা চালাতে দেখলেন। এ সময় তিনি কিছু তরুণ মুসলমানের সঙ্গে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিলেন এবং ইটপাটকেল ছুড়ে ওই হিন্দুদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন। অথচ মুসলিম লিগের এমন একজন একনিষ্ঠ কর্মী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই দলটি ছেড়ে দিলেন?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যেদিন আইন পরিষদে ঘোষণা দিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতেই হবে; সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান চরমভাবে বেদনাহত হলেন। তরুণ মুজিবুর রহমান এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানাতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাজপথে নেমে এলেন। তিনি এ সময় পাকিস্তানের বিরোধিতা করেননি। তিনি কেবল তাঁর রাজনৈতিক অধিকারের অংশ হিসেবে মাতৃভাষার সমর্থনে সোচ্চার হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুজিব মুক্তি পান। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বেঁচে নেই। মুজিবও মুসলিম লিগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লিগে যোগ দিলেন তিনি। পাঁচ বছরের মধ্যেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লিগকে ধরাশায়ী করে ফেলল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হলেন এবং প্রাদেশিক কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ সরকার এই পরাজয় মেনে নিল না এবং অন্যায়ভাবে ঢাকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার গ্রেপ্তার করা হলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী অসমাপ্ত রয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই আত্মজীবনীতে উল্লিখিত কিছু ঐতিহাসিক সত্যকে মেনে নিতে হবে।
ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে আমি কোনো বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় লেখকের উদ্ধৃতি দেব না। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব যখন কারাবন্দী, তখন জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তাঁর সেনা কর্মকর্তাদের প্রস্তুত করছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রথম চিফ অব জেনারেল স্টাফ শের আলি পাতৌদি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আইয়ুব রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং একদিন তাঁকে (শের আলি পাতৌদি) বলেছিলেন, ‘এই সব রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবীরা অপদার্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত আর অযোগ্য।’ আইন পরিষদ জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সকে সেনাবাহিনীতে বাঙালি সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছিল। পাতৌদি আইন পরিষদের নির্দেশ পালনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইয়ুবের কোনো আগ্রহ ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে বসে আত্মজীবনী লিখছিলেন, তখন আইয়ুব সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মাদ মুনীর। এই মুহাম্মাদ মুনীর ১৯৭৯ সালে জিন্নাহ থেকে জিয়া শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, আইয়ুব খান তাঁকে বলেছিলেন, পাকিস্তান আলাদা হওয়ার ইস্যুতে তাঁর (মুহাম্মাদ মুনীর) প্রভাবশালী বাঙালি নেতাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আইনমন্ত্রী মুনীর এর পর রমিজ উদ্দিন নামের একজন বাঙালি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। মুনীর লিখেছেন, তাঁর (রমিজ উদ্দিন) জবাব ছিল তাৎক্ষণিক এবং সোজাসাপ্টা। ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি (প্রাদেশিক সরকারের) অপসারণ চাই কি না। আমি তাঁকে হ্যাঁ সূচক অথবা কনফেডারেশন অথবা আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পক্ষে বললাম।’ রমিজ উদ্দিন বললেন, ‘দেখুন, আমরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেদিক থেকে যারা সংখ্যালঘু তারা খারিজ হতে পারে, আমরা নই। কারণ আমরাই আসল পাকিস্তান।’ আইয়ুব কেন বাঙালিদের অপছন্দ করতেন? এর কারণ হলো, ১৯৬৫ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাঙালিরা আইয়ুবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিল। ঢাকায় শেখ মুজিব ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহর প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা।
আসল সত্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সামরিক সরকার তখন তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তিনি কখনোই রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে সরে আসেননি এবং ১৯৭০ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সামরিক অভিযান চালানো হয় পূর্ব পাকিস্তানে।
ওই অভিযানে কী হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে আমি মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন রাজার (যিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেন) লেখা বই এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় সিনিয়র বাঙালি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ বক্তব্য দেন। নিয়াজি উত্তেজিত ছিলেন এবং উর্দুতে কথা বলা শুরু করেন। নিয়াজি বলেন, ‘ম্যায় ইস হারামজাদে ক্বওমকি নাসাল বাদাল দোঙ্গা। ইয়ে মুঝে কিয়া সামাঝতি হ্যায়?’( এই হারামজাদা জাতির আদল আমি বদলে দেব। তারা আমাকে কী মনে করে?) তিনি তাঁর অধীন সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নারীদের ধর্ষণ করতে। পরদিন সকালে লজ্জায়-অপমানে মেজর মুশতাক নামের একজন বাঙালি অফিসার কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের বাথরুমে গিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আমি আরও অনেক পাকিস্তানি লেখকের বইয়ের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যাঁরা স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি মুসলমানদের ওপর ব্যাপক হারে শুধু গণহত্যাই চালায়নি, বরং নিয়াজির নির্দেশমতো অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে। এখানে আমি থামব।
আমি শুধু বলতে চাই, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হচ্ছে এমন এক ঐতিহাসিক দলিল, যা প্রমাণ করেছে বাঙালিরা কখনোই পাকিস্তান ভাঙেনি; বরং প্রকৃতপক্ষে তারাই পাকিস্তানের আসল স্রষ্টা। আদতে সামরিক একনায়কদের রাজনৈতিক চক্রান্ত ও খামখেয়ালিই পাকিস্তানকে ভেঙে দুই ভাগ করেছে। বাঙালি নারীদের রক্ষার জন্য বাঙালি পুরুষদের অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছিল। আমরাই তাদের অস্ত্র ধরতে বাধ্য করেছিলাম। আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, সাহসী লোকেরাই নিজেদের ভুল স্বীকার করে। ভুল স্বীকার করে বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কিছুটা হলেও সাহস দেখানোর সময় এখন এসেছে। আমাদের সেই ক্ষমা প্রার্থনা পাকিস্তানকে দুর্বল নয় বরং আরও শক্তিশালী করবে।
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
অনেক পাকিস্তানির কাছে শেখ মুজিবুর রহমান একজন খলনায়ক। একপেশে ইতিহাসের বই বলছে, মুজিব ছিলেন বিশ্বাসঘাতক; তিনি ভারতের মদদ নিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙে দুই ভাগ করেছিলেন। আমাদের ইতিহাসের বইগুলো পড়ে আমরা জেনেছি, ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই ঢাকাতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে (প্রকৃতপক্ষে তারা আত্মসমর্পণ করেছিল বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে) আত্মসমর্পণ করেছিল, সে কথা আমরা জানি না। আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা দিয়ে ইতিহাসের কলঙ্ক ঢাকার চেষ্টা করেছি; শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী (দি আনফিনিশড মেমোয়ার) আমাদের স্কুল-কলেজে পাঠ্য সব দাপ্তরিক ইতিহাসের বইকে বাতিল করে দিয়েছে।
এই আত্মজীবনীতে পরিষ্কার হয়েছে, বিশ্বাসঘাতক মুজিব স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায়ই পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্মৃতিকথায় তিনি নিজের সম্বন্ধে সত্য ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৩৯ সালে নিজ শহর গোপালগঞ্জে মুসলিম লিগের যাত্রা শুরুর বিষয়ে তিনি যে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন, সে কথা তিনি চেপে যাননি। অধিকন্তু, মুজিব একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন, বাঙালি নেতা ফজলুল হক ১৯৪১ সালে যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেছিলেন, তখন মুসলিম লিগ ওই সময় ফজলুল হকের বিরোধিতা করে প্রচারণা শুরু করে। শেখ মুজিব নিজে সেই প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হকের সঙ্গে ছিলেন না; পরিষ্কারভাবে ছিলেন জিন্নাহপন্থী। ওই সময় মুসলিম লিগের যেসব তরুণ কর্মী ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানপন্থী সাপ্তাহিক মিল্লাত বিক্রি করে বেড়াতেন, মুজিব ছিলেন তাঁদেরই একজন।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো সেটি হলো, জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের আমলে কারাবন্দী থাকার সময় শেখ মুজিবুর রহমান এই বইটি লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন খুব সততার সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অসততা উন্মোচন করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, একটি পর্যায়ে এসে তিনি মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে কংগ্রেস পার্টির চালানো কর্মকাণ্ডে গোপনে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু একজন সামরিক একনায়কের জেলে বন্দী থেকেও তিনি ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির মন জয়ের চেষ্টা করেননি।
১৯৪৭ ও ১৯৫৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পূর্ণ হয়ে ওঠা পাকিস্তানের রাজনীতির একটি অভূতপূর্ব দলিল এই বই। আমি মনে করি, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই বই সত্যিকার ইতিহাসের একটি অনন্য উৎস। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, বইটিতে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। মুজিব লিখেছেন, একদিন তিনি কয়েক শ হিন্দুকে একটি মসজিদে হামলা চালাতে দেখলেন। এ সময় তিনি কিছু তরুণ মুসলমানের সঙ্গে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিলেন এবং ইটপাটকেল ছুড়ে ওই হিন্দুদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলেন। অথচ মুসলিম লিগের এমন একজন একনিষ্ঠ কর্মী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই দলটি ছেড়ে দিলেন?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যেদিন আইন পরিষদে ঘোষণা দিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতেই হবে; সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান চরমভাবে বেদনাহত হলেন। তরুণ মুজিবুর রহমান এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানাতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাজপথে নেমে এলেন। তিনি এ সময় পাকিস্তানের বিরোধিতা করেননি। তিনি কেবল তাঁর রাজনৈতিক অধিকারের অংশ হিসেবে মাতৃভাষার সমর্থনে সোচ্চার হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুজিব মুক্তি পান। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বেঁচে নেই। মুজিবও মুসলিম লিগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নতুন দল আওয়ামী মুসলিম লিগে যোগ দিলেন তিনি। পাঁচ বছরের মধ্যেই আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লিগকে ধরাশায়ী করে ফেলল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হলেন এবং প্রাদেশিক কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ সরকার এই পরাজয় মেনে নিল না এবং অন্যায়ভাবে ঢাকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে আবার গ্রেপ্তার করা হলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী অসমাপ্ত রয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই আত্মজীবনীতে উল্লিখিত কিছু ঐতিহাসিক সত্যকে মেনে নিতে হবে।
ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে আমি কোনো বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় লেখকের উদ্ধৃতি দেব না। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব যখন কারাবন্দী, তখন জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তাঁর সেনা কর্মকর্তাদের প্রস্তুত করছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রথম চিফ অব জেনারেল স্টাফ শের আলি পাতৌদি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আইয়ুব রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং একদিন তাঁকে (শের আলি পাতৌদি) বলেছিলেন, ‘এই সব রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবীরা অপদার্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত আর অযোগ্য।’ আইন পরিষদ জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সকে সেনাবাহিনীতে বাঙালি সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছিল। পাতৌদি আইন পরিষদের নির্দেশ পালনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইয়ুবের কোনো আগ্রহ ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান যখন জেলে বসে আত্মজীবনী লিখছিলেন, তখন আইয়ুব সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মাদ মুনীর। এই মুহাম্মাদ মুনীর ১৯৭৯ সালে জিন্নাহ থেকে জিয়া শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, আইয়ুব খান তাঁকে বলেছিলেন, পাকিস্তান আলাদা হওয়ার ইস্যুতে তাঁর (মুহাম্মাদ মুনীর) প্রভাবশালী বাঙালি নেতাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আইনমন্ত্রী মুনীর এর পর রমিজ উদ্দিন নামের একজন বাঙালি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। মুনীর লিখেছেন, তাঁর (রমিজ উদ্দিন) জবাব ছিল তাৎক্ষণিক এবং সোজাসাপ্টা। ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি (প্রাদেশিক সরকারের) অপসারণ চাই কি না। আমি তাঁকে হ্যাঁ সূচক অথবা কনফেডারেশন অথবা আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পক্ষে বললাম।’ রমিজ উদ্দিন বললেন, ‘দেখুন, আমরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেদিক থেকে যারা সংখ্যালঘু তারা খারিজ হতে পারে, আমরা নই। কারণ আমরাই আসল পাকিস্তান।’ আইয়ুব কেন বাঙালিদের অপছন্দ করতেন? এর কারণ হলো, ১৯৬৫ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাঙালিরা আইয়ুবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিল। ঢাকায় শেখ মুজিব ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহর প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা।
আসল সত্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সামরিক সরকার তখন তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তিনি কখনোই রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে সরে আসেননি এবং ১৯৭০ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সামরিক অভিযান চালানো হয় পূর্ব পাকিস্তানে।
ওই অভিযানে কী হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে আমি মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন রাজার (যিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেন) লেখা বই এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছেন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় সিনিয়র বাঙালি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ বক্তব্য দেন। নিয়াজি উত্তেজিত ছিলেন এবং উর্দুতে কথা বলা শুরু করেন। নিয়াজি বলেন, ‘ম্যায় ইস হারামজাদে ক্বওমকি নাসাল বাদাল দোঙ্গা। ইয়ে মুঝে কিয়া সামাঝতি হ্যায়?’( এই হারামজাদা জাতির আদল আমি বদলে দেব। তারা আমাকে কী মনে করে?) তিনি তাঁর অধীন সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নারীদের ধর্ষণ করতে। পরদিন সকালে লজ্জায়-অপমানে মেজর মুশতাক নামের একজন বাঙালি অফিসার কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের বাথরুমে গিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আমি আরও অনেক পাকিস্তানি লেখকের বইয়ের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যাঁরা স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি মুসলমানদের ওপর ব্যাপক হারে শুধু গণহত্যাই চালায়নি, বরং নিয়াজির নির্দেশমতো অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে। এখানে আমি থামব।
আমি শুধু বলতে চাই, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হচ্ছে এমন এক ঐতিহাসিক দলিল, যা প্রমাণ করেছে বাঙালিরা কখনোই পাকিস্তান ভাঙেনি; বরং প্রকৃতপক্ষে তারাই পাকিস্তানের আসল স্রষ্টা। আদতে সামরিক একনায়কদের রাজনৈতিক চক্রান্ত ও খামখেয়ালিই পাকিস্তানকে ভেঙে দুই ভাগ করেছে। বাঙালি নারীদের রক্ষার জন্য বাঙালি পুরুষদের অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছিল। আমরাই তাদের অস্ত্র ধরতে বাধ্য করেছিলাম। আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, সাহসী লোকেরাই নিজেদের ভুল স্বীকার করে। ভুল স্বীকার করে বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কিছুটা হলেও সাহস দেখানোর সময় এখন এসেছে। আমাদের সেই ক্ষমা প্রার্থনা পাকিস্তানকে দুর্বল নয় বরং আরও শক্তিশালী করবে।
হামিদ মির: পাকিস্তানের জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv
No comments:
Post a Comment