বাংলাদেশকে নিজের দেশ বলে মনে করি
সৈয়দ আসিফ শাহকার
সৈয়দ
আসিফ শাহকার। জন্মসূত্রে পাকিস্তানি। এখন সুইডেনের নাগরিক। সাধারণ নাগরিক
নন, সে দেশের বিচারপতি তিনি। এই প্রথম এলেন বাংলাদেশে। অথচ এ দেশটির
মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। এ দেশে না এসেও কেমন করে জড়িয়ে পড়লেন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, কেমন করেই বা হয়ে উঠলেন সুইডেনের নাগরিক? ১৩
ডিসেম্বর প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন তিনি। শোনান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
তাঁর জড়িয়ে পড়ার বৃত্তান্ত। তিন সন্তানের জনক আসিফ শাহকার গর্ব করেন সেই
সংগ্রামে অংশ নিতে পেরেছিলেন বলে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: পার্থ শঙ্কর সাহা
প্রথম আলো: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন কেমন করে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আমি তখন ২২ বছরের তরুণ। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এই সময়ে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব শক্তি নিয়ে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখনো কিন্তু দেশের একটি অংশের মানুষের ওপর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সেই হত্যাযজ্ঞের খবর রাখেনি বা রাখতে চায়নি পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু সে অঞ্চলের শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ সেই বর্বরতার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। আমাদের সংগঠন খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সমর্থক ছিল। ন্যাপ এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল। আমরাও প্রতিবাদ করলাম। গণহত্যা বন্ধের দাবি জানালাম। পাঞ্জাবে তখন সমাবেশ করতাম। প্রতিবাদী লিফলেট বিলি করতাম। সে সময় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কবিতাও লিখেছি। আমাদের একটা ছোট্ট দল ছিল। এখানে ছিলেন প্রয়াত হাফিজ আহমেদ, দুই ভাই বাসিত মির, আর্সনাল মির ও রাজকুমার ব্যানার্জি। আমাদের এ সময় বেইমান ও দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। লোকজন আমাদের ভীষণ অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। আমরা যখন সমাবেশ করতাম তখন কেউ কেউ আমাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারত। পাকিস্তানি সামরিক চক্র আমাদের এসব প্রতিবাদ সহ্য করল না, তাই আমাকে গ্রেপ্তার করল। এরপর কারাদণ্ড দিল।
প্রথম আলো: বন্দী অবস্থায় কেমন করে দিন কাটত আপনার?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: পাঞ্জাবের লাহোরের ক্যাম্প জেলে বিশেষ ব্যবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল আমাকে। সারা দিনে ২২ ঘণ্টা বন্দী করে রাখা হতো একটি ঘরে। যে ঘরে থাকা, সেই ঘরেই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু। মানসিক ও শারীরিক—সব রকমের নির্যাতন চলেছে আমার ওপর।
প্রথম আলো: আপনি বন্দী হওয়ার পর এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল? কোনো প্রতিবাদ?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: দুর্ভাগ্যজনকভাবে না। কোনো প্রতিবাদ তো দূরের কথা, পাকিস্তানের মানুষের কাছে তখন আমি একজন ঘৃণ্য দেশদ্রোহীতে পরিণত হয়েছিলাম। আমি প্রতিদিন নির্যাতন ভোগ করেছি কারাগারে। আর মগজ ধোলাই হওয়া পাকিস্তানিদের কাছে আমার পুরো পরিবারও এই ছেলের জন্য ঘৃণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। সেই সময় আমাকে জেলে দেখতে আসতেন আমার বাবা। তিনি বলতেন, এত বড় নোংরা কাজ করার জন্য বাবা হিসেবে তিনি লজ্জিত। অন্য কোনো অপরাধ করলেও তিনি এতটা লজ্জা পেতেন না। নিজের বাবার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনা আমার জন্য কতটা কষ্টদায়ক ছিল, সেটা একবার ভাবুন।
প্রথম আলো: আপনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন কবে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পরপরই, অর্থাৎ ষোলোই ডিসেম্বরের পর আমি মুক্তি পেলাম অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে। এই বাংলাদেশের বিজয় আমাকে জীবন দান করল। যদি সেই যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী না হতো, তবে আমার একটাই গন্তব্য হতো, তা হলো মৃত্যু। কোথায় যে আমার লাশ থাকত, আমার পরিবারও তার সন্ধান কোনো দিন পেত না। সেই জন্য বাংলাদেশের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা।
প্রথম আলো: জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আপনি কী করলেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কিছু সময় কাজ করি পাকিস্তান টেলিভিশনে (পিটিভি)। আমি প্রযোজক ছিলাম। কিন্তু এই ‘কুলাঙ্গারের’ পক্ষে পাকিস্তানে থাকাটা দুরূহ হয়ে ওঠে। তাই দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিই সুইডেনে, ১৯৭৭ সালে। সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করি। এরপর মাত্র দুবার পাকিস্তানে গেছি। আমি এখন সুইডেনের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনো দেখেছেন? কীভাবে মূল্যায়ন করেন তাঁকে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: শেখ মুজিবের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বিরাট মাপের নেতা। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি। তবে একবার পাকিস্তানে গিয়ে তাঁকে যে ‘শাহিওয়াল জেলে’ বন্দী রাখা হয়েছিল, সেই জেলখানায় গিয়েছিলাম। ওইখানেই বিপ্লবী ভগৎ সিংকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রতি আপনার ভালোবাসা অনেক, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবারও এখানে আসেননি কেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: গত ৪১ বছরে এ দেশে না এলেও আমার হূদয়জুড়ে সব সময় থেকেছে বাংলাদেশ। এ দেশের খবর রাখি সব সময়। কখনো একজন পর্যটক হয়ে আসতে চাইনি এ দেশে। এ দেশের সংগ্রামের সহযাত্রী হয়ে আসতে চেয়েছি। এবারে সেই আহ্বান এল। তাই এলাম, মুক্তিযুদ্ধের সুহূদ হয়ে। বাংলাদেশকে আমি আমার দেশ বলে মনে করি। এটাই আমার ঘর। আমি বাংলাদেশের একজন, তা ভেবে গর্ববোধ করি।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার চার দশক পর সম্মান পেলেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: ৪১ বছরের প্রতিটি মুহূর্তে আমি এই আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করেছি। ৪১ বছর পর এই সম্মান আমি পেলাম। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান। আমি আপ্লুত, অভিভূত। আমি এখন গর্ব করে বলতে পারব, আমি দেশদ্রোহী নই। আমি একটি দেশের মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশে না এলেও নিয়মিত বাংলাদেশের খোঁজখবর রাখি আমি। নিয়মিত পড়ি রবীন্দ্রনাথ, তবে ইংরেজিতে।
প্রথম আলো: আপনার জন্মস্থানে আপনি দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত। কোনো কষ্টবোধ আছে আপনার?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: পাকিস্তানের কাছে আমি দেশদ্রোহী, এতে আমার দুঃখ নেই। আমি মনে করি, পাশবিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি এর চেয়ে খারাপ কোনো উপমা জোটে, তা-ও মেনে নেব নিশ্চিন্তে। সারা জীবন একটি কষ্ট আমাকে ভুগিয়েছে খুব। যখন বাংলাদেশিদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো জায়গায় পরিচয় ঘটেছে, পাঞ্জাবি মনে করে তাদের কাছেও ভৎর্সনাই পেয়েছি। পাকিস্তানের কাছেও আমি দেশদ্রোহী আর পাঞ্জাবি হওয়ার কারণে যাঁরা আমাকে চেনেন না, সেসব বাঙালির কাছে আমি ঘৃণিত। এটাই আমার জীবনের বড় দুর্ভাগ্য।
তবে আমার সব কষ্ট ম্লান হয়ে গেছে এবার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পেয়ে। এখন আমি আর বেইমান নই।
প্রথম আলো: আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, আপনার অনুভূতি কী?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: ৪১ বছর চলে গেছে, তা-ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল এই বিচার। কিন্তু অনেক দেরিতে হলেও যে শুরু হয়েছে, এর শুভ সমাপ্তি হোক—এটা কামনা করি।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আমার কাছে মনে হয়েছে, গত চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। আর্থিক, সামাজিক—সব দিক দিয়ে। এ দেশে একটি উদার সমাজ তৈরি হয়েছে। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যায়। আপনাকে বলতে পারি, এ দেশের মতো মুক্ত পরিবেশ পাকিস্তানে নেই। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো।
প্রথম আলো: পাকিস্তান এখনো একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়নি। আপনি কি মনে করেন না যে ওদের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: অবশ্যই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সে সময় গণহত্যা চালিয়েছিল, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম কিন্তু এখন সেটা বুঝতে পারছে। আমার মনে হয়, সাধারণ পাকিস্তানিরাই একদিন শাসকদের বাধ্য করবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আপনাকেও ধন্যবাদ। প্রথম আলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: পার্থ শঙ্কর সাহা
প্রথম আলো: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন কেমন করে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আমি তখন ২২ বছরের তরুণ। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এই সময়ে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব শক্তি নিয়ে বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখনো কিন্তু দেশের একটি অংশের মানুষের ওপর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সেই হত্যাযজ্ঞের খবর রাখেনি বা রাখতে চায়নি পশ্চিম পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু সে অঞ্চলের শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ সেই বর্বরতার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। আমাদের সংগঠন খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সমর্থক ছিল। ন্যাপ এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল। আমরাও প্রতিবাদ করলাম। গণহত্যা বন্ধের দাবি জানালাম। পাঞ্জাবে তখন সমাবেশ করতাম। প্রতিবাদী লিফলেট বিলি করতাম। সে সময় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কবিতাও লিখেছি। আমাদের একটা ছোট্ট দল ছিল। এখানে ছিলেন প্রয়াত হাফিজ আহমেদ, দুই ভাই বাসিত মির, আর্সনাল মির ও রাজকুমার ব্যানার্জি। আমাদের এ সময় বেইমান ও দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। লোকজন আমাদের ভীষণ অপছন্দ করতে শুরু করেছিল। আমরা যখন সমাবেশ করতাম তখন কেউ কেউ আমাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারত। পাকিস্তানি সামরিক চক্র আমাদের এসব প্রতিবাদ সহ্য করল না, তাই আমাকে গ্রেপ্তার করল। এরপর কারাদণ্ড দিল।
প্রথম আলো: বন্দী অবস্থায় কেমন করে দিন কাটত আপনার?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: পাঞ্জাবের লাহোরের ক্যাম্প জেলে বিশেষ ব্যবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল আমাকে। সারা দিনে ২২ ঘণ্টা বন্দী করে রাখা হতো একটি ঘরে। যে ঘরে থাকা, সেই ঘরেই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু। মানসিক ও শারীরিক—সব রকমের নির্যাতন চলেছে আমার ওপর।
প্রথম আলো: আপনি বন্দী হওয়ার পর এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল? কোনো প্রতিবাদ?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: দুর্ভাগ্যজনকভাবে না। কোনো প্রতিবাদ তো দূরের কথা, পাকিস্তানের মানুষের কাছে তখন আমি একজন ঘৃণ্য দেশদ্রোহীতে পরিণত হয়েছিলাম। আমি প্রতিদিন নির্যাতন ভোগ করেছি কারাগারে। আর মগজ ধোলাই হওয়া পাকিস্তানিদের কাছে আমার পুরো পরিবারও এই ছেলের জন্য ঘৃণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। সেই সময় আমাকে জেলে দেখতে আসতেন আমার বাবা। তিনি বলতেন, এত বড় নোংরা কাজ করার জন্য বাবা হিসেবে তিনি লজ্জিত। অন্য কোনো অপরাধ করলেও তিনি এতটা লজ্জা পেতেন না। নিজের বাবার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনা আমার জন্য কতটা কষ্টদায়ক ছিল, সেটা একবার ভাবুন।
প্রথম আলো: আপনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন কবে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পরপরই, অর্থাৎ ষোলোই ডিসেম্বরের পর আমি মুক্তি পেলাম অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে। এই বাংলাদেশের বিজয় আমাকে জীবন দান করল। যদি সেই যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী না হতো, তবে আমার একটাই গন্তব্য হতো, তা হলো মৃত্যু। কোথায় যে আমার লাশ থাকত, আমার পরিবারও তার সন্ধান কোনো দিন পেত না। সেই জন্য বাংলাদেশের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা।
প্রথম আলো: জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আপনি কী করলেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কিছু সময় কাজ করি পাকিস্তান টেলিভিশনে (পিটিভি)। আমি প্রযোজক ছিলাম। কিন্তু এই ‘কুলাঙ্গারের’ পক্ষে পাকিস্তানে থাকাটা দুরূহ হয়ে ওঠে। তাই দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিই সুইডেনে, ১৯৭৭ সালে। সুইডেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করি। এরপর মাত্র দুবার পাকিস্তানে গেছি। আমি এখন সুইডেনের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনো দেখেছেন? কীভাবে মূল্যায়ন করেন তাঁকে?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: শেখ মুজিবের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বিরাট মাপের নেতা। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য আমার কখনো হয়নি। তবে একবার পাকিস্তানে গিয়ে তাঁকে যে ‘শাহিওয়াল জেলে’ বন্দী রাখা হয়েছিল, সেই জেলখানায় গিয়েছিলাম। ওইখানেই বিপ্লবী ভগৎ সিংকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রতি আপনার ভালোবাসা অনেক, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবারও এখানে আসেননি কেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: গত ৪১ বছরে এ দেশে না এলেও আমার হূদয়জুড়ে সব সময় থেকেছে বাংলাদেশ। এ দেশের খবর রাখি সব সময়। কখনো একজন পর্যটক হয়ে আসতে চাইনি এ দেশে। এ দেশের সংগ্রামের সহযাত্রী হয়ে আসতে চেয়েছি। এবারে সেই আহ্বান এল। তাই এলাম, মুক্তিযুদ্ধের সুহূদ হয়ে। বাংলাদেশকে আমি আমার দেশ বলে মনে করি। এটাই আমার ঘর। আমি বাংলাদেশের একজন, তা ভেবে গর্ববোধ করি।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার চার দশক পর সম্মান পেলেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: ৪১ বছরের প্রতিটি মুহূর্তে আমি এই আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করেছি। ৪১ বছর পর এই সম্মান আমি পেলাম। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান। আমি আপ্লুত, অভিভূত। আমি এখন গর্ব করে বলতে পারব, আমি দেশদ্রোহী নই। আমি একটি দেশের মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশে না এলেও নিয়মিত বাংলাদেশের খোঁজখবর রাখি আমি। নিয়মিত পড়ি রবীন্দ্রনাথ, তবে ইংরেজিতে।
প্রথম আলো: আপনার জন্মস্থানে আপনি দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত। কোনো কষ্টবোধ আছে আপনার?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: পাকিস্তানের কাছে আমি দেশদ্রোহী, এতে আমার দুঃখ নেই। আমি মনে করি, পাশবিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি এর চেয়ে খারাপ কোনো উপমা জোটে, তা-ও মেনে নেব নিশ্চিন্তে। সারা জীবন একটি কষ্ট আমাকে ভুগিয়েছে খুব। যখন বাংলাদেশিদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো জায়গায় পরিচয় ঘটেছে, পাঞ্জাবি মনে করে তাদের কাছেও ভৎর্সনাই পেয়েছি। পাকিস্তানের কাছেও আমি দেশদ্রোহী আর পাঞ্জাবি হওয়ার কারণে যাঁরা আমাকে চেনেন না, সেসব বাঙালির কাছে আমি ঘৃণিত। এটাই আমার জীবনের বড় দুর্ভাগ্য।
তবে আমার সব কষ্ট ম্লান হয়ে গেছে এবার মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পেয়ে। এখন আমি আর বেইমান নই।
প্রথম আলো: আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, আপনার অনুভূতি কী?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: ৪১ বছর চলে গেছে, তা-ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল এই বিচার। কিন্তু অনেক দেরিতে হলেও যে শুরু হয়েছে, এর শুভ সমাপ্তি হোক—এটা কামনা করি।
প্রথম আলো: স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আমার কাছে মনে হয়েছে, গত চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। আর্থিক, সামাজিক—সব দিক দিয়ে। এ দেশে একটি উদার সমাজ তৈরি হয়েছে। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যায়। আপনাকে বলতে পারি, এ দেশের মতো মুক্ত পরিবেশ পাকিস্তানে নেই। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো।
প্রথম আলো: পাকিস্তান এখনো একাত্তরে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়নি। আপনি কি মনে করেন না যে ওদের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
সৈয়দ আসিফ শাহকার: অবশ্যই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সে সময় গণহত্যা চালিয়েছিল, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম কিন্তু এখন সেটা বুঝতে পারছে। আমার মনে হয়, সাধারণ পাকিস্তানিরাই একদিন শাসকদের বাধ্য করবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ আসিফ শাহকার: আপনাকেও ধন্যবাদ। প্রথম আলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
No comments:
Post a Comment