Wednesday, December 5, 2012

দুর্নীতিতে ২৪ ধাপ অবনতি

দুর্নীতিতে ২৪ ধাপ অবনতি




দুর্নীতি বিস্তারের ক্ষেত্রে গত এক বছরে বাংলাদেশের ২৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। টিআই পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ গত বছর বিশ্বের ১৮৩টি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যে সূচক করা হয়েছিল, তাতে ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০ নম্বরে। আর এবার ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪তম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দুর্নীতিতে অবনতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশের মধ্যে ৫টির অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। অবনতি হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের। এর মধ্যে পাকিস্তানের অবনতি ৫ ধাপ আর বাংলাদেশের ২৪ ধাপ। স্কোরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। ২০১১ সালের ২৭ স্কোর কমে এবার হয়েছে ২৬। রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ নম্বরে। এ বিবেচনায় গত বছরও বাংলাদেশ একই অবস্থানে ছিল।
বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল গতকাল সারাবিশ্বে একযোগে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। বাংলাদেশে রিপোর্ট প্রকাশকালে বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। সকালে রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নগামী; কারণ স্কোর কমেছে। এ অবস্থা উদ্বেগজনক। গত বছর ১০-ভিত্তিক স্কেলে সূচক নির্ধারণ করা হলেও এবার অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে একশ-ভিত্তিক স্কেলে। গত বছর ১০-এ বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২.৭। আর এবার ১০০-তে ২৬।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে সম্প্রতি টিআইবি সরকারের তোপের মুখে পড়ে। সংসদের ভেতরে-বাইরে সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা টিআইবিকে তুলোধুনো করেই থামেননি, বাংলাদেশে সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ করারও দাবি তুলেছেন। শতকরা ৯৯ ভাগ সংসদ সদস্য নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত—এমন গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করার জন্য তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এমনই পরিস্থিতিতে গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। টিআইবি’র নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীলরা না থাকলে এবারের রিপোর্ট আরও খারাপ আসত বলে সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা। রিপোর্ট প্রকাশের সময় সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল উপস্থিত ছিলেন।
টিআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ২০১১ সালের সঙ্গে ২০১২ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানগত পরিবর্তন না হলেও গত এক বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেল দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের কথা।
এবারের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। এ তিন দেশের স্কোর ১০০-তে ৯০। গত বছর ভালোর তালিকায় শীর্ষে ছিল নিউজিল্যান্ড। ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ড ছিল দুই নম্বরে।
এবার সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির দেশ হিসেবে এসেছে আফগানিস্তান, কোরিয়া ও সোমালিয়ার নাম। দেশগুলোর স্কোর ১০০-তে ৮। গত বছর সর্বশেষ অবস্থানে ছিল শুধু সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া।
এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ আমলের শেষ বছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৫ সাল থেকে (২০০৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে) বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। চারদলীয় জোট সরকারের সময় দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বর থেকে তৃতীয়তে উন্নীত হয় এবং বিএনপি জোটের শেষ বছর ২০০৬ সালে (রিপোর্ট প্রকাশ ২০০৭ সালে) অবস্থার আরও উন্নতি হয়ে ৭ নম্বরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। পরের বছরগুলোতে যথাক্রমে ১০, ১৩, ১২ এবং ১৩তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বছর এ ধারণাসূচক প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির দাবি, এ সূচকে দুর্নীতি বিস্তারের একটি ধারণা পাওয়া যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র : দক্ষিণ এশিয়া তথা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। তাদের স্কোর ১০০-তে ৬৩। ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী তাদের অবস্থান ৩৩। দেশটি এক বছরে পাঁচ ধাপ উন্নতি করেছে। গত বছর তাদের অবস্থান ছিল ৩৮ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটি ৪০ স্কোর করে ৭৯ নম্বরে অবস্থান করছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটি ৩৬ স্কোর করে ৯৪ নম্বরে উঠেছে। গত বছর তাদের স্কোর ছিল ২৭ এবং অবস্থান ছিল ১২০ নম্বরে। বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা অপর দুটি দেশ হচ্ছে পাকিস্তান ও নেপাল। এ দুটি দেশ ২৭ করে স্কোর করেছে এবং যুগ্মভাবে তাদের অবস্থান ১৩৯ নম্বরে। পাকিস্তানের স্কোর ৫ পয়েন্ট এবং নেপালের ২ পয়েন্ট বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় স্কোর কমেছে একমাত্র বাংলাদেশের। স্কোর ১ কমে ২৬-এ নেমেছে এবং অবস্থান ১২০ থেকে একলাফে ২৪ ধাপ নেমে ১৪৪-এ পতিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে মালদ্বীপ এ বছর সিপিআই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
অবস্থা উদ্বেগজনক : ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নগামী। এর কারণ স্কোর কমেছে। এ অবস্থা উদ্বেগজনক। ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশের স্কোর ২৬, যা গত বছরের তুলনায় এক পয়েন্ট কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেল দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের বিষয়।
টিআইবির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটা প্রতিষ্ঠানটির ১৮তম বার্ষিক দুর্নীতির ধারণা সূচক। এবারের সূচকে বিশ্বের ১৭৬টি দেশের পাবলিক সেক্টরের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সমান স্কোর করেছে ক্যামেরুন, ইউক্রেন, কঙ্গো রিপাবলিক, সিরিয়া ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।
রিপোর্টে বলা হয়, দুর্নীতি একটি মারাত্মক বৈশ্বিক সমস্যা। কোনো দেশই ১০০ স্কোর পায়নি। কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত অনেক দেশই ৮০ স্কোরের কম পেয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্পেন ও ইতালি। ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১২৪টি দেশ ৫০-এর কম স্কোর পেয়েছে। বৈশ্বিক গড় (সহনীয় দুর্নীতি) ৪৩ স্কোরের কম পাওয়া দেশের সংখ্যা ৬৭টি।

No comments:

Post a Comment