Friday, December 7, 2012

রাজপথ অবরোধে সরকারে আতঙ্ক

বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি সরকারের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে সরকার দেশব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকার বিএনপির সাবেক দু’জন জনপ্রিয় ওয়ার্ড কমিশনারসহ ১০ জন নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি মোকাবিলায় ছাত্রলীগ-যুবলীগকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। সরকার মহাজোটের শরিক ছাড়াও বাম দলগুলোকে মাঠে নামাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা জামায়াত ঠেকানোর নামে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে। তবে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বলেছেন, সরকারের দমন-পীড়নে কাজ হবে না। সরকারের মধ্যে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, সেই আতঙ্ক থেকেই তারা এসব করছে।
নেতারা বলেন, জনগণ সবক্ষেত্রে ব্যর্থ মহাজোট সরকারকে আর চায় না, নির্দলীয় সরকার পুনর্বহাল করে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগই হবে মঙ্গল—আগামীকালের অবরোধ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে এ বার্তাই দিতে চায় ১৮ দলীয় ঐক্যজোট।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে ডাকা এই অবরোধ কর্মসূচিকে সরকারের জন্য সতর্ক সঙ্কেত, গণঅভ্যুত্থানের পূর্বমহড়া হিসেবে জোটের শীর্ষ নেতারা অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, এদিন রাজধানীকে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াই হবে অবরোধের লক্ষ্য। সারাদেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে। এ কর্মসূচিকে সফল করতে ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বলেও জানান তারা।
বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপি স্থায়ী কমিটি ও ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে অবরোধ কর্মসূচিতে জোটের নেতাকর্মীদের রাজপথে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, অবরোধ কর্মসূচি পালনে কোনো ধরনের বাধা দেয়া হলে পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মসূচি ঠিক করা হবে। এক্ষেত্রে হরতালসহ কঠোর ধরনের কর্মসূচিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তবে নিজ থেকে সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানানোর কথাও বলেন তিনি। ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোয় গত নির্বাচনে যারা ওই এলাকা থেকে নির্বাচন করেছেন, তারা নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাজপথে অবস্থান নেবেন বলে বৈঠকে আলোচনা হয়।
অবরোধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার দেশ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম এমপি, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী, খেলাফত মজলিস আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ও জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের অন্যায় আচরণ এবং নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অবরোধ দেয়া হয়েছে। ওইদিন রাজধানীকে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে এ বার্তাই দিতে চাই যে, বর্তমান সরকারকে জনগণ আর চায় না। জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি রাজপথে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি সফল করতে। ওইদিন রাজপথে গাড়ি চলবে না। সারাদেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে। বাস-ট্রাক-মিনিবাস শ্রমিকদের অনুরোধ জানাচ্ছি, দয়া করে সেদিন কেউ গাড়ি বের করবেন না।
তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তুতি ব্যাপক। আমাদের দলের সিনিয়র নেতারা সারাদেশে গণসংযোগ করছেন। অনেক প্রস্তুতি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আশা করছি অবরোধ সফল হবে। আমাদের এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।
ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম এমপি : লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি—এলডিপি প্রেসিডেন্ট ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম এমপি বলেন, বিগত প্রায় ৪ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি-কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছি। এর মূল লক্ষ্য ছিল সরকারকে বোঝানো, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি কার্যত দেশ ও জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। এছাড়াও আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় লিখিতভাবে বের হওয়ার আগেই সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। তত্কালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসর যাওয়ার প্রায় দেড় বছর পর এই মামলার একটি রায় দেন। মূলত তিনিই সরকারের পরামর্শে এই বিতর্কিত রায় দিয়ে দেশকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। কারণ এখনও পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া রাজনীতিবিদরা দিব্যি মিথ্যা কথা বলে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। আমাদের কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে আমরা জনগণকে রাজনীতির সঠিক পথে আনার চেষ্টা করছি। আমরা চাই, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু একটি নির্বাচন, জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত ও সব স্তরে জনগণের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ। কিন্তু কয়েকজন রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরণের জন্য দেশ সঠিক পথে চলছে না। অবরোধসহ আমাদের কর্মসূচিগুলো হচ্ছে সরকারের জন্য একটি সতর্ক সঙ্কেত। আমরা চাই সরকার জনগণের সমস্যা ও দেশের সমস্যাগুলো উপলব্ধি করুক এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহাল করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় দলীয় প্রভাবমুক্ত হোক। সরকার যদি কোনো অবস্থায় আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেয়, তাহলে লাগাতার কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো।
তিনি বলেন, অবরোধ কর্মসূচির জন্য আমাদের প্রস্তুতি খুবই ভালো। মহানগর, জেলা, থানা, পৌরসভা-ইউনিয়নগুলোতে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের উদ্যোগে কর্মসূচিটি যথাযথভাবে পালন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে পরদিনও কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুফতি ফজলুল হক আমিনী : ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, সরকারের কাছে আমাদের ম্যাসেজ একটাই এবং তা হচ্ছে—এই সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ। এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করে অবিলম্বে পদত্যাগ করে সরকারকে চলে যেতে হবে। জনগণের কাছেও আমাদের ম্যাসেজ রয়েছে। তা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ রক্ষার আন্দোলনে অংশ নিয়ে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করুন।
তিনি বলেন, আগামী রোববারের অবরোধে আমাদের প্রস্তুতি ব্যাপক। সারাদেশে আমরা আমাদের সব সামর্থ্য নিয়ে অবরোধে অংশ নেব।
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক : খেলাফত মজলিস আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেছেন, অবরোধের মাধ্যমে আমরা সরকারকে এটাই দেখিয়ে দিতে চাই বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। তাই সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করে পদত্যাগ করা।
তিনি বলেন, অবরোধে অংশগ্রহণের জন্য তার দলের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। মহানগর, জেলা-উপজেলা সব জায়গায় আমাদের দল সব সামর্থ্য নিয়ে মাঠে থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। শান্তিপূর্ণভাবে আমরা কর্মসূচিতে অংশ নেব। কোনো ধরনের উস্কানি ও কর্মকাণ্ডে আমরা লিপ্ত হবো না। পুলিশ বা যানবাহনের দিকে কোনো ধরনের ঢিলও ছুড়ব না।
ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ : বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি—বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বর্তমান সরকার সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোট পেয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। তাই তাদের আর ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করে পদত্যাগ করাই হবে বর্তমান সরকারের জন্য মঙ্গল। আমাদের অবরোধ কর্মসূচি হচ্ছে এই দাবিরই সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, অবরোধ কর্মসূচিতে আমরা আমাদের পূর্ণ জনশক্তি নিয়ে মাঠে থাকব। এ নিয়ে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।
শফিউল আলম প্রধান : জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি—জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেছেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, একটি ষড়যন্ত্রের পটভূমিতে ক্ষমতায় এসেছে। তারপরও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমরা এ সরকারকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু বিগত ৪টি বছর ধরে এ সরকার যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, গণতন্ত্র তো পরের কথা, দেশের স্বাধীন সত্তাই থাকে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অবরোধের মাধ্যমে আমরা সরকারকে এই বার্তা দিতে চাই যে, সরকার আমাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে পুনর্বহাল করবে, নতুবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, অবরোধ হবে গণঅভ্যুত্থানের পূর্বমহড়া। এদিন রাজধানীকে দেশের আর অন্যসব এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। পরে বঙ্গভবন ও গণভবনও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। তিনি বলেন, অবরোধ কর্মসূচিতে আমরা আমাদের সাধ্যমত অংশগ্রহণ করব।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা ৯ তারিখের অবরোধ কর্মসূচি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে চাই। এই কর্মসূচিতে আমাদের আলাদা কোনো দাবি নেই। ১৮ দলের শরিক দল হিসেবে একই মেসেজ দেয়া হবে, তা হলো—বর্তমান স্বৈরশাসনের অবসান এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করা। আশা করি সরকারের সুমতি হবে। কেননা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। অবরোধ কর্মসূচি উপলক্ষে জামায়াতের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, শরিক দল হিসেবে এ কর্মসূচিতে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ ও ভূমিকা থাকবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment