আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে আমাদের নারী শ্রমিকঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা।
ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সৌদি আরব থেকে বাসার কাজে নিয়োজিত মহিলা শ্রমিকদের ফেরত নিচ্ছে। নেপাল সরকার ৩০ বছরের নিচের মহিলাদের মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ভারতে আগে থেকেই এই ধরনের একটি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এই স্পর্শকাতর বিষয়ে কতটা সচেতন? ‘সারা বিশ্বে অভিবাসী শ্রমিকদের ৪৯ শতাংশই নারী হলেও বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ নারী। তথাপিও এরই মধ্যে এদেশি নারীশ্রমিকদের একটা বড় অংশ নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির মুখে পরেছেন। বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, লেবাননে। তাই নারী অভিবাসন সংগঠনগুলো নারীশ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসনের দাবি জানিয়েছে।বিদেশে জনশক্তি রফতানি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই যে ভাল অবস্থা, তার একটা বড় কারণ প্রতি মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো মোটা অংকের রেমিটেন্স। যেখানে নারী শ্রমিকদের ভূমিকাও একেবারে কম নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে; অর্থমন্ত্রীর কপালের ভাজ মোচনের মহান দায়িত্বটি যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাদের ভাল মন্দের কতটুকু খোজ সরকার রাখে তা বিদেশে শ্রম বিক্রিতে নিয়োজিত শ্রমিক বিশেষকরে মহিলা শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্রই বলে দেয়। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে যে আমাদের কিছুই করনিয় নেই, তা নয়। কিছু কিছু পদক্ষেপ এই সমস্যার সমাধানে অনেকটা ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজন দায়িত্ববোধ ও সদিচ্ছা।
এক কালের কপর্দকহীন বর্বর আরবরা আজ ধনবান হয়েছে সত্য কিন্তু সভ্য হতে পারেনি। তাদের জৌলুসের আড়ালের অসভ্যতার বলি হয় দরিদ্র প্রবাসীরা। এখানে প্রবাসী পুরুষ শ্রমিকরা কাটান বন্দী জীবন। তারা বাধ্য হন ১৮/২০ ঘণ্টার টানা কাজ করতে। এরপরে পান অপ্রতুল খাবার,। তাদের আবাসস্থল নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। অর্থাৎ তারা চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হন অহরহ। আর নারী শ্রমিকদের বেলায় এর পাশাপাশি যোগ হয় যৌন নির্যাতনের বিষয়টি। মহিলা শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে ইউএনডিপির এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমার দেশে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিদেশে বাংলাদেশী মহিলা শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হন। তাদের অনেকে চুক্তি অনুযায়ী বেতন পান না। দেশে ফিরে এসে ওইসব নির্যাতিত নারী শ্রমিক ট্রাভেল এজেন্ট, কর্মস্থলের ঠিকানা ও মালিকের নাম দিতে না পারায় তাদের জন্য কোনও পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হয় না। এখানে লক্ষণীয়, নির্যাতিত এই নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রাম্য মহিলা। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ নারী শ্রমিক বিদেশে যান কোনও দালাল, আত্মীয়ের মাধ্যমে। বিদেশে গিয়ে তারা কি কাজ করবেন তার কোনও দিকনির্দেশনা থাকে না।
আমাদের দেশে অনেক ছোট ছোট রিক্রুটিং এজেন্সি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যারা বিদেশে জনশক্তি রফতানি করে। কিন্তু তাদের রেকর্ড নেই। ন্যূনতম মানদণ্ডের বালাই নেই। জানা যায় আমাদের দেশ থেকে মাত্র ৯ শতাংশ নারী শ্রমিক যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিদেশে যান। বাদবাকিদের এ সবের বালাই নেই। যাদের বেশিরভাগই আবার অক্ষরজ্ঞানহীন। এরা বিদেশে গিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়েন। কপাল চাপড়ানো আর নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া তাদের আর করার কিছু থাকে না। যৌন হয়রানি, নানান নির্যাতন ও বঞ্চনা ছাড়াও ঘাতক ব্যাধি এইডসে আক্রান্ত হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তারা। সেই সাথে দেশের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট হয় এদের ইচ্ছা অনিচ্ছায় ঘটা বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনায়।
এ অবস্থায় মহিলা শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় এবং দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে লক্ষ রাখা জরুরী।
১। ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করা।
২। দালালদের দৌরাত্ন বন্ধ করা ।
৩। অদক্ষ মহিলা শ্রমিক প্রেরণ না করা।
৪। মহিলা শ্রমিকদের বয়স সীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ নির্ধারণ করা।
৫। মধ্যপ্রাচ্যের গৃহকর্মীরা শ্রম আইনের আওতায় পড়েন না। এটা অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য আশংকার বড় কারণ। শ্রমিক প্রেরণের পূর্বেই আগ্রহী দেশগুলোর সাথে যথাযথ চুক্তি স্বাক্ষর করে সে দেশের সরকারের দায়িত্বে এই শ্রমিকদের পাঠান উচিৎ। সে চুক্তির আওতায় নির্ধারিত থাকবে ন্যুনতম বেতন কাঠামো সাপ্তাহিক ছুটি, থাকবে চিকিৎসা বীমা। এছাড়া নিয়োগ কর্তা/ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রশিক্ষণ এবং যাওয়ার খরচের বিষয়টিরও সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
৬। অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত নারী শ্রমিকদের বেলায়; স্বামী ছাড়া একা কোন নারী শ্রমিক বিদেশে যেতে পারবেনা এ ধরনের একটি বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে একদিকে যেমন একই সাথে দুজনের কর্মসংস্থান হয়। তেমনি নারী শ্রমিকটির নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়। আর এটা জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাবও ফেলবে না কেননা জনশক্তি আমদানি কারক দেশগুলো নারী শ্রমিক এর পাশাপাশি হাউজ ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, মালী হিসেবে পুরুষ শ্রমিকও নিতে চায়। প্রয়োজন সমন্বয় সাধন।
৭। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর উত্তর শহরতলীতে মহিলা অভিবাসী শ্রমিকদের জন্যে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। সব অভিবাসী শ্রমিকদের জন্যে এখানে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। সরকারের লাইসেন্স নিয়ে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি এটা পরিচালনা করে। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এর একজন প্রশিক্ষক শিবা চন্দ্র ম্যানুয়েল বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের ভাষা এবং ঘর পরিষ্কার, কাপড় ধোয়া ও রান্না করা শেখাই। আমি তাদের প্রয়োজনীয় অফিসসমূহ যেমন দূতাবাস, শ্রম মন্ত্রণালয়, বিদেশ ভ্রমণ এবং শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে ধারণা দেই। চাকুরিদাতা নির্যাতন করলে কিভাবে নিরাপদ থাকতে হবে সেটাও আমি তাদের শেখাই।” গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো নারীদের ইন্দোনেশিয়ায় ৬ মাসের, এবং ফিলিপাইনে ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এদেশে মাত্র ২১ দিনের প্রশিক্ষণে তাদের এসব সমস্যা দুর করা কতটা সম্ভব তা বিবেচনার দাবী রাখে। যারা ঐসব দেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাদের ২১ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ পূর্নাঙ্গ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে প্রত্যেক নারী শ্রমিকের এই কেন্দ্র হতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা।
৮। সর্বোপরি বিদেশ গমনেচ্ছু নারী শ্রমিকদের একমাত্র সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিদেশে পাঠানো উচিত। যেমনটি হংকং, থাইল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে করা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে অশিক্ষিত এবং অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে দক্ষ ও ন্যুনতম স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মহিলা শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যথাযথ। যাতে তারা খুব সহজেই সেখানকার পোশাক শিল্প, সেবা প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কিছুটা হলেও সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন। এতে তাদের নিরাপত্তা যেমন রক্ষিত হবে সেইসাথে রেমিটেন্স এর প্রবাহও বৃদ্ধি পাবে।
আমরা ইতিমধ্যে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে হাটতে শুরু করেছি। এই ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের রেমিটেন্সের উপর গুরুত্বারোপ করা জরুরী। সেইসাথে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাও গুরুত্বপূর্ণ। আর তা করতে হলে স্কিলড জনশক্তি রপ্তানির বিকল্প নেই। বিদেশে অশিক্ষিত-অদক্ষ নারী শ্রমিক পাঠিয়ে আমরা আমাদের নারীদের ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে। ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদেরকে এ ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলে আমরা নিজেরাও কি এই নারী নির্যাতনের দায় এড়াতে পারি?
kmgmehadi@yahoo.com
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, দৈনিক জনকণ্ঠ, এশিয়া কলিং এবং আমার দেশ।
No comments:
Post a Comment