বন্ধুর
পথে বধূর যাত্রা
-
-
আবু
বকর সিরাজী
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ইরশাদ করেন-
ثَلاَثَةٌ
لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ اَلْعَاقُ
بِوَالِدَيْهِ وَالدَّيُوْثُ وَرَجلةُ
النِّسَاءِ –
‘তিন
শ্রেণীর মানুষ জান্নাতে প্রবেশ
করবে না। পিতামাতার অবাধ্য
সন্তান,
স্ত্রীকে
বেপর্দা ও পরপুরুষের সঙ্গে
মিশতে দেয়া স্বামী,
এবং
পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী
নারী।’
[নাসাঈ
:
১/২৭৫]
এখানে
আমি এমন একটি ঘটনা তুলে ধরব,
যা
এই হাদীস অমান্য করার করুণ
পরিণতি হিসেবে আখ্যায়িত হতে
পারে। আমার নিজ কানে শোনা ঘটনা
এটা। মর্মাহত যুবক নিজ মুখে
শুনিয়েছেন তার ব্যর্থতাভরা
জীবনকাহিনী। তা শুনেছে অসংখ্য
শ্রোতা।
যুবকের
বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। পারিবারিকভাবে
বেশ সম্ভ্রান্ত। ভাইয়েরা
থাকেন আমেরিকায়।
নিজেকে
প্রতিষ্ঠা করার একটা উদ্যমী
চেষ্টা কাজ করে তার মধ্যে
সর্বদা। কিন্তু মাধ্যমিক
ক্লাসে পড়ার সময়ই পিছুটান।
আপন খালাতো বোনের তরফ থেকে
প্রেমপ্রস্তাব পান তিনি।
বিফলে আত্মহত্যা!
এমন
নিখাঁদ প্রেম আর হয় না!
অন্য
কোনও যুবক হলে হয়ত তৎক্ষণাত
লাফিয়ে পড়ত এই গরম কড়াইয়ে।
চিন্তা করত না নিজের ভবিষ্যতের
কথা আর একজন অবুঝ কিশোরীর
আত্মহত্যার মিথ্যা আস্ফালনের
অসারতা। কিন্তু সুমন এক্ষেত্রে
অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয়
দেন। যৌবনের উন্মাদনার কাছে
নিজেকে সঁপে না দিয়ে বাস্তবতার
রুক্ষভূমিতে পড়ে থাকেন দাঁতে
কামড় দিয়ে অনেক দিন। খালাতো
বোন লিলি (ছদ্মনাম)কে
তিনি আগে পড়াশোনা শেষ করার
পরামর্শ দেন। লিলি নিবৃত হয়,
তবে
একেবারে না। কিছুদিন পর আবার
প্রেমের ডালি নিয়ে হাজির হয়
সে সুমনের সামনে। একজন যুবতী
নারীর পুনঃপুনঃ প্রেমপ্রস্তাব
জোয়ারের পানির মতো আছড়ে পড়তে
থাকে সুমনের জীবন-উপকূলে।
ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে ভেঙে পড়তে
থাকে বরফখণ্ডের মতো শক্ত
সুমনের হৃদয়পাড়। প্রেম আর
যৌবনের উচ্ছ্বাসের কাছে হার
মানতে শুরু করেন তিনি।
হৃদয়
যদি ঈমান আর আল্লাহপ্রেমের
শরাব দ্বারা সিক্ত না হয়,
তাহলে
একজন যুবতী নারীর পুনঃপুনঃ
আহবানে সাড়া না দিয়ে থাকা একজন
পুরুষের পক্ষে বেশ কঠিন ব্যাপারই
বটে। তাই লিলির আহ্বানে সাড়া
দিতে তিনি বাধ্য হন।
সুমনের
পা পিছলে যাওয়ার এই ঘটনাটা
ঘটেছিল ছাত্রজীবনে।
সঙ্গত
কারণেই তার পিতা-মাতা
বিষয়টি মেনে নিতে প্রস্তুত
হন নি। বিশেষ করে তার বাবা
ছেলের এই বক্রপথচলাকে কোনোভাবেই
মেনে নেন নি। সুমন প্রশ্রয়
পেয়েছেন কিছুটা মায়ের কাছে,
বাকিটা
ভাবি শ্বাশুড়ী তথা খালার কাছে।
দিন গড়ায় আর সুমন লিলিদের
প্রেমের গাঁটও শক্ত-পোক্ত
হয়। এখন আর প্রেম-প্রেমের
লুকোচুরি খেলা সাজে না। তাই
দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন
সংসার পাতবার। জন্মদাতা
বাবা-মার
যে দায়িত্ব ছিল,
তারা
সেই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে
নিলেন। পিতৃত্ব আর মাতৃত্বের
প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা
নিজেরাই নিজেদের বিয়ের পিঁড়িতে
বসলেন। যে মা পেটে ধারণ করেছেন
এবং যে পিতা সংসারসমুদ্রের
কঠিন দাঁড় বেয়ে সন্তানদেরকে
মানুষ করার ঘাঁটে পৌঁছিয়েছেন,
সেই
মা-বাবা
থাকলেন অজানাদের কাতারে।
সুমন বঞ্চিত হলেন বাবা-মায়ের
অকৃত্রিম দু‘আ
থেকে আর লিলি বঞ্চিত হলো
মা-বাবাতুল্য
শ্বশুর-শাশুড়ীর
মাথায় হাত রেখে দু‘আ নেয়া
থেকে।
বিয়ের
কারবার ঘটল খুলনায় সুমনের এক
বন্ধুর বোনের বাসায়।
লিলি
পালাবার সময় বাড়ি থেকে প্রায়
এগারো ভরি স্বর্ণ নিয়ে গিয়েছিল।
তা থেকে নয় ভরি স্বর্ণ বিক্রি
করল নব্বই হাজার টাকায়। কিন্তু
বিয়ের কিছুদিন পরেই লিলি তার
আসলরূপ চেনাতে শুরু করে।
উপার্জনহীন স্বামীর ওপর চাপাতে
লাগল বিলাসিতার কঠিন বোঝা।
বায়না ধরতে লাগল অপ্রয়োজনীয়
বিলাসসামগ্রীর আয়োজন করে
দেবার। কিন্তু একজন ছাত্র
স্বামীর পক্ষে সম্ভব ছিল না
তার এসব কঠিন বায়না পূরণ করা।
তাই বাধ্য হয়ে লেখাপড়ার পাঠ
চুকিয়ে রোজগারের উদ্দেশ্যে
ঢাকামুখী স্রোতে গা ভাসিয়ে
দিলেন সুমন। তাকে সাহায্য
করলেন এক সময়ের বন্ধু এক পুলিশ
অফিসার। পল্টনের একটি অফিসে
তাকে চাকরী জোগাড় করে দিলেন।
তবে বেতন খুবই কম। মাত্র ৩২০০
টাকা। এই অল্প বেতন দিয়ে নিজের
থাকা-খাওয়া
এবং বিলাসী স্ত্রীর মনোবাসনা
পূরণ করা পাথর কামড়ে খাওয়ার
মতো কঠিন হয়ে উঠল সুমনের জন্য।
এদিকে স্ত্রীর দাবি যে কোনও
মূল্যে স্বামীর সঙ্গে থাকার।
এসব বায়নায় রীতিমত চোখে সর্ষেফুল
দেখতে লাগলেন সুমন। শেষে অপরাগ
হয়ে স্ত্রীকে তিনি ঢাকায় নিয়ে
এলেন। এরই মধ্যে দাম্পত্যের
চিরন্তন বাস্তবতার শাশ্বত
স্বপ্ন প্রবেশ করে লিলির
গর্ভে। কিন্তু লিলি সুমনের
এই স্বপ্নটাকে মুহূর্তে
মাটিচাপা দেয়। বাবার বাড়ি
বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে পেটের
বাচ্চাটাকে কী এক অদৃশ্য
ইশারায় নষ্ট করে আসে সে।
এর
কিছুদিন পর আবার সেই স্বপ্ন
চুমো এঁকে দেয় সুমনের ভাগ্যাকাশে।
এবার আর ভুল করেন নি সুমন।
প্রশ্রয় দেননি লিলির ‘বাপের
বাড়ি যাওয়ার’
আব্দার।
সুমনের সচেতনতায় কোল আলো করে
জন্ম নেয় সিনথিয়া নামের এক
ফুটফুটে কন্যা। নতুন আমেজে
নতুন আবেগে সংসার শুরু করেন
তিনি। টানাটানির সংসারে
ভাগ্যময়ূরী হয়ে আভির্ভূত হয়
সিনথিয়া। ভাগ্যের সহায়তায়
এক ডেভলপমেন্ট কোম্পানীতে
চাকুরী হয় সুমনের। বেতন আাগের
চেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে স্ত্রীকে
গুলশানের এক কাপড়ের দোকানে
সেলস্ম্যানের চাকুরী জুটিয়ে
দেন তিনি।
এভাবে
স্বামী-স্ত্রীর
যৌথ আয়ে সংসারের চাকাটা বেশ
স্বাচ্ছন্দেই ঘুরছিল। কিন্তু
লিলির সেই বায়না ধরা আর বিলাসিতার
অভ্যাস কেটে যায় নি। বরং ঢাকার
গরম বাতাস আর বিত্তবৈভবের ঝড়
তার জীবনকে আরও আগ্রাসী করে
তোলে। বায়নার তালিকায় যোগ
হতে থাকে নতুন-নতুন
নাম। এদিকে জামাতার সীমিত
আয়ে শাশুড়ীও বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
সুমনের ভাষ্যানুযায়ী তার
শাশুড়ী মেয়ে লিলির চেয়ে অনেক
বেশি বিলাসী। এদিকে স্বামী
একজন সামান্য বেতনের পোস্টমাস্টার।
তাই তার দ্বারা বিলাসী আয়োজন
সম্পন্ন হতো না। আশা জাগত
জামাইয়ের সহায়তা পাবেন। কিন্তু
জামাইয়ের অবস্থাও তথৈবচ!
তাই
বিরক্ত শ্বাশুড়ী মেয়ের
সুখচিন্তায় নতুন পথ বের করে
নেয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এসময়ে
পরিচয় হয় আমেরিকা প্রবাসী
লিলির দূর সম্পর্কীয় এক তথাকথিত
ভাই মুজরিমের সঙ্গে।
লিলির
মা-ই
তাকে লিলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দেন। পরিচয়সূত্রে মুজরিমের
সঙ্গে এখন লিলির নিয়মিত যোগাযোগ
হয়। তারা প্রাণ খুলে কথা বলে
মোবাইলে। আস্তে-আস্তে
সুমন থেকে মন উঠে যেতে থাকে
লিলির। কিন্তু সুমন তাকে
ভালোবেসে যান পাগলের মতো।
নিজের জন্য কিছু না করে,
নিজে
না খেয়ে স্ত্রীর মনোবাসনা
পূরণ করতে সচেষ্ট থাকেন তিনি।
অফিসে কম্পিউটারের কাজ করতেন।
অনেক সময় উপরি কামাই হতো তার।
সেই উপরি কামাইটা তুলে রাখতেন
প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য।
ভালোবাসার রংধনুতে যোগ করতে
চাইতেন নতুন-নতুন
বর্ণ।
কিন্তু
নারীমন পাঠ করা নাকি বিধাতা
ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়
না। তাই এই নারীমনে গজিয়ে ওঠে
হাজারও নতুন চারা। আমেরিকার
ছেলেটির সঙ্গে নিয়মিত মোবাইল
যোগাযোগে তার চিন্তার পাখায়
যোগ হয় নতুন-নতুন
পালক। জেগে ওঠে নতুন স্বপ্ন।
ব্যাপারটি আঁচ করতে পারেন
সুমন। তাই স্ত্রীকে নিজের
সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে ভালোবাসার
পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেন। কিন্তু
ভালোবাসার বিশ্বাসে তার
মানসিকতা উদার।
তাই
যেখানে ছাড় দেয়া অপরাধ,
সেখানেও
ছাড় দেন। মরার আগেই নিজহাতে
খনন করেন নিজের কবর!
প্রথমে
লিলির মোবাইল জব্দ করেন তিনি।
সেই মোবাইলের সিমটা ছিল মোবাইল
টু মোবাইল সিস্টেমের। দেশের
বাইরে কল যেত না। আমেরিকার
ছেলেটি কল করলেই তবে তার সঙ্গে
কথা হত।
কিন্তু
এই মোবাইল বিক্রি করার পর
লিলির পীড়াপীড়ি বেড়ে যায়।
অনেক কষ্ট করে সাড়ে চার হাজার
টাকা দিয়ে তিনি আরেকটি মোবাইল
ও সিম কেনেন। মোবাইলটা ০১৭১৫...
ডিজিটের।
হীতে বিপরীত হয় সুমনের। ঘোল
বেঁচে দুধ পেয়ে যায় লিলি। আর
সুমন মেঘ থেকে পালিয়ে আশ্রয়
নেন পরনালার নিচে!
কেননা,
এই
সিমটি আইএসডি। বিশ্বের যে
কোনো স্থানে অবাধে কল যায়।
আমেরিকান ছেলেটি লিলির হাতের
মুঠোয় এসে যায়। এবার শুধু তার
কলের অপেক্ষা নয়,
সে
নিজেও তাকে কল দেয়। এভাবে
পরকীয়ার আগুনেখেলায় মেতে ওঠে
লিলি,
আর
তাকে সাহায্য করছিলেন স্বামী
সুমন নিজের অজান্তেই!
এভাবে
অশুভ এক পরিণতির দিকে এগিয়ে
যাচ্ছিলেন সুমন। পিতামাতার
অমতে পালিয়ে বিয়ে করার রেশ
এখনও কাটেনি। স্তন্যদাত্রী
মা ছেলের অপরাধ ভুলে স্নেহদান
করলেও পিতা ছেলের অপরাধ ক্ষমা
করেন নি। তাই স্বরচিত বিয়ের
পিঁড়িতে বসার পর আজও বাড়ির
পথে পা মাড়ানোর সুযোগ আসে নি
সুমনের তরে। সঙ্গত কারণেই
স্ত্রীর কাছে সব ভালোবাসা,
সব
স্নেহ,
সব
আদর আর সব অনুপ্রেরণা পাওয়ার
যোগ্য ছিলেন তিনি। কিন্তু
স্ত্রী ভালোবাসার কৃত্রিম
অভিনয়টুকু প্রদর্শন করতেও
সক্ষম হয় নি !
আরেকটি
চরম ভুল করেছিলেন স্বামী সুমন।
একবার আমেরিকা থেকে মুজরিম
মূল্যবান কিছু উপহার পাঠিয়েছিল
লিলির নামে। মূল্যবান বলতে
পশ্চিমা সভ্যতার প্রতীক হরেক
রকমের বিলাসী ও প্রসাধনী
সামগ্রী। এই গিফ্টবক্সটি নিজ
হাতে বহন করেন সুমন!
প্রথমে
বোঝেননি কী বহন করছেন তিনি।
পরে
বুঝেছিলেন এটা গিফ্টবক্স নয়,
তার
স্বামিত্বের মৃত্যুপরওয়ানা!
এই
বক্সটি লিলির মনবাগানে সাজানো
সুমনের ভালোবাসার সবগুলো
ফুলগাছের গোড়া থেকে রস চুষে
নেয়। জন্ম দেয় নতুন একটি চারা।
এই চারাটি মুজরিমের প্রতি
ভালোবাসার চারা। সুদূর আমেরিকা
থেকে এই চারায় রস সিঞ্চন করত
মুজরিম। এই গিফ্টবক্স লিলির
অন্তরে আমেরিকার মানচিত্র
এঁকে দেয়। যে মানচিত্রে তার
দাম্পত্যের পতাকা বহন করবে-
স্বামী
সুমন নয়-
মুজরিম!
এদিকে
লিলিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে
যান তার মা ও সুমনের শ্বাশুড়ী
কাম আপন খালা। তারই ইশারায়
দেশে আসে মুজরিম। চোখইশারা
গোপনীয়তায় লিলি,
তার
মা এবং মুজরিমের মধ্যে একটি
‘গোপন
দলিল’
সম্পাদিত
হয়। সুমনের কল্পনা সীমানার
বাইরে সংকলিত হচ্ছিল এসব দলিল।
মুজরিম
দেশে আসার পর লিলির ব্যস্ততা
বেড়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন
স্থানে ছোটাছুটি করতে দেখা
যায় তাকে। ব্যস্ত সুমন দিনের
বেশির ভাগ সময় কাটান অফিসে।
এ সময় সুমন স্ত্রীকে সময় দিতে
পারেন না। কিন্তু লিলির তাতে
যে আক্ষেপ নেই,
আছে
স্বস্তি!
তার
এই অক্ষমতাকে প্রাণভরে উপভোগ
করে সে। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়
মুজরিমের সঙ্গে।
আর
মুজরিমের মুখে আমেরিকার গল্প
শোনে। গল্পে-গল্পে
তার মন উদাস হয়ে যায়। উদাস
দৃষ্টি মেলে সে তাকায় এমন এক
শূন্যতায় যেখানে আর সবই থাকবে
কিন্তু ‘পথের
কাঁটা’
সুমন
থাকবে না!
মধ্যবাড্ডায়
বাসা। সেখান থেকে গুলশানের
আমেরিকান এম্বেসিটা খুব দূরে
নয়। এদিকটায় তাকে বেশি আসতে
দেখা যায়। সুমনের মধ্যে এখানেও
সরলতা কাজ করে। স্ত্রীর এই
অস্থিরতাকে তিনি অনুবাদ করেন
সাধারণ ঘটনা বলে। দেখেও না
দেখার ভান করেন এসব ঘটনা।
একপর্যায়ে মুজরিম আবার আমেরিকায়
পা রাখে। থেমে যায় লিলির
অস্থিরতা,
চিলতে
শংকাটা কেটে যায় সুমনের।
এর
বেশ কিছুদিন পর লিলির কাছে
তারই নামে করা একটি আন্তর্জাতিক
পাসপোর্ট এবং আমেরিকান ভিসা
আবিষ্কার করেন তিনি। প্রথমে
অবাক হয়ে যান তার হাতে ভিসা
দেখে। জিজ্ঞেস করলে নিতান্ত
স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয় লিলি-
এমনিতেই
করে রাখলাম আর কী!
তাছাড়া
ভিসা জিনিসটা তো আর খারাপ কিছু
নয় যে,
কোনও
নারীর কাছে তা থাকতে পারে না!
এটা
ছিল ঝড়ের পূর্ভাবাস। কিন্তু
সুমনের দৃষ্টিতে সাগর ছিল
খুবই শান্ত!
একমাত্র
মেয়ে সিনথিয়া এখন চার বছরের
আদুরে খুকিটি। অফিসফেরা বাবাকে
দেখে উদ্বেলিত হয় তার শিশুমন।
বাবাকে ঝাঁপটে ধরে শিশুসুলভ
মমতায়। এটা এখন সুমন ও সিনথিয়ার
নিত্যরুটিন। কিন্তু একদিন
অফিস থেকে ফিরে ব্যতিক্রম
দেখলেন সুমন। তার পদধ্বনিতে
আজ চঞ্চল হলো না সিনথিয়ার
প্রাণ। ঘরে ঢুকে খা-খা
করা শূন্যতা অনুভব করলেন তিনি।
স্ত্রী লিলি ও আদরের কন্যা
সিনথিয়া কেউ নেই সেখানে। অজানা
আশঙ্কায় কেঁপে উঠলেন তিনি।
পাশের ফ্ল্যাটের এক মহিলার
কাছে লিলির খবর জিজ্ঞেস করলে
তিনি যে তথ্য দিলেন,
তা
বড় কলেজের পাঠক না হলে বরদাশত
করতে পারবেন কিনা তাতে আমার
সন্দেহ আছে। ওই মহিলা জানালেন,
কয়েক
ঘণ্টা আগে সিনথিয়াকে আমার
কাছে দিয়ে লিলি কোথায় যেন
গিয়েছে এবং বলে গেছে,
ওর
বাবা আসা পর্যন্ত আপনি ওকে
দেখে রাখবেন। সেই থেকে সিনথিয়া
একাকি বসে-বসে
কাঁদছে।
প্রথমটায়
ধারণা করতে পারেন নি সুমন।
একাধিকবার কল্পনা শক্তি ব্যয়
করেও লিলির গন্তব্য আবিষ্কার
করতে পারলেন না। অবশেষে ফোন
দিলেন শ্বাশুড়ীকে। শ্বাশুড়ী
উত্তাপ ও অনুশোচনাহীন কণ্ঠে
বললেন,
সে
তো মুজরিমের সঙ্গে আমেরিকায়
চলে গেছে!
সুমন
জানিয়েছেন,
যে
নারী তাকে না পেলে আত্মহত্যার
হুমকি দিয়েছিল,
সেই
নারী পাসপোর্টের ঠিকানায়
স্বামীর কোঠায় সুমনের জায়গায়
মুজরিমের নাম লিখে আমেরিকায়
পাড়ি জমিয়েছে!
যে
শ্বাশুড়ী তাকে তার মেয়েকে
বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন,
সেই
শ্বাশুড়ীই মুজরিমের কাছে
বিলাসী যিন্দেগীর আশ্বাস
পেয়ে কন্যাকে বৈধ স্বামীর
কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মুজরিমের
হাতে তুলে দিয়েছেন!
পাঠক!
এর
পর সিনথিয়া সুমনের কী হয়েছিল,
লিলি
মুজরিম কী পরিমাণ সুখ পেয়েছিল
সেসব কাহিনী আমি আর বলতে চাই
না। আপনি শুধু কল্পনা করুন,
লিলি,
লিলির
মা আর মুজরিমের বর্বরতার কথা,
যারা
মাত্র চার বছরের একটি নিরপরাধ
মেয়েকে মাতৃত্বের স্নেহ থেকে
বঞ্চিত করেছে।
সুন্দর
ও গৌরবময় ভবিষ্যত থেকে বঞ্চিত
করেছে।
সুমনের
ভালোবাসা লুট করে তাকে দিয়েছে
কলঙ্কের দাগ।
একজন
মা কি করে পারে নিষ্পাপ সন্তানকে
অন্যের হাওয়ালা করে,
স্বামীর
বন্ধন ছিন্ন করে পরপুরুষের
সঙ্গে নতুন ঘর করার উদ্দেশ্যে
আপন ঘর ছেড়ে যেতে?
আর
একজন মা-ই
বা কি করে পারে স্বামী সন্তান
ছেড়ে মেয়েকে পরপুরুষের সঙ্গে
চলে যেতে উৎসাহিত করতে?
সিনথিয়া
আজ মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত।
বাবার পক্ষে সম্ভব নয় মায়ের
মতো স্নেহ দেয়া। তার সেবা করা।
তাই মেয়েকে সুদূর খুলনায় ফুফুর
কাছে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন।
সিনথিয়া বঞ্চিত মায়ের আদর আর
বাবার স্নেহ থেকে। সুমন বঞ্চিত
সন্তানের মুখের বাবা ডাক
শুনতে। কারণ,
সিনথিয়া
তার ফুফুকে মা আর ফুফাকে আব্বা
বলে ডাকে। আর সুমনকে ডাকে মামা
বলে!
মায়ের
বদলায় দাদীর স্নেহ পাওয়ার
অধিকার থেকেও সে বঞ্চিত।
কেননা,
ছেলের
মতো নাতনীর জন্যও দাদা বাড়ির
সদর দরজাটা বন্ধ করে রেখেছেন।
আর নানীতো কন্যার নতুন নীড়
রচনায় পুরাতন সব ‘আবর্জনা’
মুছে
ফেলতে মরিয়া। সুমন স্বীকার
করেছেন,
লিলি
সম্পদের যে প্রাচুর্য দেখে
মুজরিমের হাত ধরে আমেরিকায়
পাড়ি জমিয়েছিল,
সেই
সম্পদ এখন তার হাতে গড়াগড়ি
খায়। মাসে তিনি এখন লাখ-লাখ
টাকা আয় করেন। একটু ধৈর্য ধরলে
আজ সে সম্পদের মধ্যে লুটোপুটি
খেত। কিন্তু এই ধৈর্য্য ধরার
সাহস সে দেখায় নি।
আমি
মনে করি,
শুধু
অর্থ বিত্তই এই লাঞ্ছনার জন্য
দায়ী নয়। অবাধ ও পর্দাহীন
জীবনও এর জন্য দায়ী। এরূপ জীবন
এভাবে একের পর এক করুণ ঘটনার
জন্ম দিয়ে যাবে।
পাঠক!
প্রেম,
পরকীয়া
ও বেপর্দার পরিণাম কত নিন্দনীয়
এই ঘটনা উল্লেখ করার পর তা
পুনর্ব্যক্ত করার প্রয়োজন
আছে বলে মনে করি না। [সূত্র
:
০১/০৪/২০১০
ইং তারিখে রেডিও আমার-এ
দেয়া সুমনের নিজস্ব সাক্ষাৎকার]
No comments:
Post a Comment