Thursday, December 27, 2012

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবশ্য পাঠ্য

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবশ্য পাঠ্য

মোনায়েম সরকার | ২৭ december ২০১২ ৮:১৭ অপরাহ্ন
bongobondhu.gifকারাগারে বসে লেখা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অসমাপ্ত হলেও একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে এ গ্রন্থ একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। তাঁর আত্মজীবনী শুধু এক রাজনীতিকের স্মৃতিকথা নয়, উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেরও এক অনন্য স্মৃতিভাণ্ডার। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শত শত বই বের হয়েছে, কিন্তু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র সঙ্গে অন্য কোনো বইয়ের তুলনা হয় না। বস্তুত একটি জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা ভিত্তি রচনা করে তার যথার্থ জাতীয় আত্মপরিচয়ের, এমন কিছু অনন্য মানুষের অভ্যুদয় হয়, যাঁরা হন সেই জাতির নতুন ইতিহাস স্রষ্টা, দেশের দিশারী। এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুরের দক্ষিণতম প্রান্তিক এক জনপদে ক্রমান্বয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম (১৯২০, ১৭ মার্চ) বিধাতার এমনই এক দাক্ষিণ্য– যিনি নিজস্ব যোগ্যতায় সমকালীন আরও অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে পেছনে রেখে এগিয়ে এসেছিলেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জনক হিসেবে। তারই সুযোগ্য আত্মজা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উৎসাহে সম্প্রতি প্রকাশিত (জুন, ২০১২) হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৩২৯ পৃষ্ঠার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও তার ৩২৩ পৃষ্ঠার ইংরেজি অনুবাদটি (The Unfinished Memoirs)। এই আত্মজীবনী আমাদের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণার বিষয়।
টুঙ্গিপাড়ার কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন এক প্রবল প্রভাবশালী বংশের উত্তরসুরি তিনি। একদা বাড়ির চার ভিটায় প্রতিষ্ঠিত মোগল আমলের সরু ইটের চারটা দালান। সময়ের পরিক্রমায় কালক্রমে ভগ্নপ্রায় বলেই সেই প্রাসাদের পরিবর্তে পাশেই তৈরি টিনের ঘরে তাঁর বসবাস। বঙ্গবন্ধুর নিজের বয়ান : ‘আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি’।
একদা তাঁর পূর্বসুরি শেখ কুদরতউল্লাহ প্রতিপক্ষ নীলকর সাহেবের সঙ্গে মামলায় জিতে আধা পয়সা জরিমানা করে বলেছিলেন, ‘টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নাই। তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছো; আমি প্রতিশোধ নিলাম’। ইংরেজ সাহেবকে শেখ কুদরতউল্লাহ এই ‘আধা-পয়সা জরিমানার’ কাহিনী গান হিসেবে টুঙ্গিপাড়ার পাশ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর ওপারের খুলনা জেলায় এখনও শোনা যায়।
শেখ মুজিব রাজনীতিতে এত ব্যাপক জনসম্পৃক্ত ও জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে এলাকার বালক-বৃদ্ধ, পিতা-পুত্র, মা-কন্যা সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। সারাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেন ভরসার স্থল ও তাদের সুখ-দুঃখের চির সাথী মুজিব ভাই। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যারা পড়বেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন আমাদের পরিচিত শেখ মুজিবুর রহমান মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে কীভাবে স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই কালজয়ী বিশ্ববিখ্যাত ৭ মার্চের ভাষণে। কী করে জননেতা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার স্থপতি তথা বাঙালির আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বহু ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যা অনেক প্রখ্যাত লেখকের পক্ষেও সম্ভব নয়। যেমন আজমীর শরিফে খাজাবাবার দরগা জিয়ারত, লালকেল্লা, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ ইত্যাদি দেখার প্রসঙ্গ। তাজমহল দেখার স্মৃতি বর্ণনা অসাধারণ ও নিুরপ :
‘সূর্য অস্তাচলগামী, আমরাও তাজমহলের দরজায় হাজির। … সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালী রং আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা খুলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বছর পর লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই। আর ভুলতে পারব না। দারোয়ান দরোজা বন্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাজমহলেই ছিলাম। পরের দিন সকালবেলা আমাদের যেতে হবে ফতেপুর সিক্রিতে।’
এমন সহজ-সরল ব্যক্তিগত জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরের বর্ণনায় যে অন্তর্দৃষ্টি তাও লক্ষণীয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রথম থেকেই আমলাতন্ত্রের যে প্রবল প্রতাপ তার উত্তাপ বোঝা যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৫ পৃষ্ঠার বর্ণনা থেকে :
‘১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে, সেই সময় জনাব লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। …যদিও তাঁরই হুকুমে এবং নূরুল আমিন সাহেবের মেহেরবানীতে আমরা জেলে আছি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। … রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তাঁর মন্ত্রিত্বে একজন সরকারি আমলাকে গ্রহণ করলেন, এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারি কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। … আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল।’ এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর তুলে ধরা যায়।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, সৌন্দর্যবোধ ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তির কথা ও আব্বাস উদ্দীনের গানে মুগ্ধ হওয়ার ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
বাংলা মূল বই ও তার ইংরেজি অনুবাদ উল্লেখযোগ্য দ’টি কারণে : (১) এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছয় পৃষ্ঠার একটি ভূমিকায় সমৃদ্ধ এবং ভাষান্তরটি যথার্থই প্রশংসনীয়। এজন্য এর অনুবাদক অবশ্যই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞার পাত্র। মূল বাংলা এবং তার ইংরেজি অনুবাদ দুটিরই মুদ্রণ এবং প্রকাশনা সৌকর্য নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের। ভারত ও পাকিস্তানে ইংরেজি ও উর্দুতে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সমগ্র বাঙালির জাতির শ্রেষ্ঠতম সন্তান জাতির পিতার আত্মজীবনী প্রকাশের ছয় মাস পরও কেন অর্ধ লাখ কপি বিক্রয় অতিক্রম করতে পারল না, তা এক বিস্ময়। অথচ এ বইটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের অবশ্যই পড়া উচিত ছিল।
সত্য কথা স্পষ্ট করে বলতে পারাই একটি মহৎ কাজ। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বাঙালির ও বাংলার সংগ্রামমুখর ইতিহাসের একটি অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল, বাঙালির জীবনে যা অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। স্বামী বিবেকানন্দ একটা কথা বলতেন ও বিশ্বাস করতেন ‘ফাঁকি দিয়ে চালাকি করে বৃহৎ ও মহৎ কাজ করা যায় না।’ বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে এবং তার মাত্র ৫৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব, শেখ মুজিব তাঁর জীবনের প্রতিটি কালপর্বে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগ, শ্রম ও মেধার স্বাক্ষর রেখেই অগ্রসর হয়েছেন। তাই তিনি বাঙালি চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো অগ্রজ নেতাদের ছাড়িয়ে শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনের এই অসমাপ্ত কিন্তু অসামান্য আত্মজীবনী এমন অসংকোচ সত্যেরই এক অনন্য নিদর্শন এবং জাতির জন্য একটি অনিঃশেষ আলোকবর্তিক বিশেষ।
আমরা প্রায়ই ক্রান্তিকালের কথা বলি, কিন্তু আজ সত্যিই জাতির এক কঠিন ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়েছে। বাংলাদেশ কি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় থাকবে, না পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধারায় ফিরে যাবে, এ প্রশ্ন সামনে এসেছে। আজ একাত্তরের মতো আর এক অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি এই বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা এই অসাধারণ অসমাপ্ত আত্মজীবনীটি সময় উপযোগী এই কারণে যে, আজকের আওয়ামী লীগের যে দশা, তার থেকে বের হতে হলে ’৭০-এর নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বের মতো বঙ্গবন্ধুর নামেই আবেগ সৃষ্টি করে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নামে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। যারা আওয়ামী লীগের নেতা হবেন বা এমপির নমিনেশন চাইবেন, তাদের এই আত্মজীবনীর ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর পরীক্ষা নেওয়া দরকার। যারা ৭০ শতাংশের কম নম্বর পাবেন, তাদের নেতৃত্ব এবং নমিনেশন থেকে বাদ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিশবার্গ’ বক্তৃতার মতো স্কুলে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীও জীবনী গ্রন্থ হিসেবে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা, নীতি, আদর্শ ও মননে গড়ে উঠবে।

No comments:

Post a Comment