আটলান্টিক পাড়ে পাকিস্তানিদের কড়চা এবং বিজয় দিবসের ভাবনা
ক্যাটাগরী:
মেজর ওয়াসেতের সাথে পরিচয় বিজয়ের মাসের শুরুর দিকেই উনি
পাকিস্তানের আর্মি অফিসার।একটা বিশেষ অপারেশন্ অর্ডার নিযে আ্মাদেরই মূলত
সাহায্য করার জন্য আইভরিকোষ্টের তাইই ক্যাম্পে এসেছিল,উনার সাথে খুব
অল্পতেই আমার ভাল সম্পর্কঃ হয়ে যায়,কথাবার্তায় বেশ নম্র ভদ্র,মার্জিত
এবং দেখতেও সুশ্রী।আইভরিকোষ্টের সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা
হয়,এখানে পাক আর্মির অনেক সদস্য পিসকীপার হিসাবে কর্মরত আছে,তাদের
ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রান্সপোর্টঃ,ফরম্ড পুলিশ ইউনিট ছাড়াও রয়েছে একটি
সেনাবাহিনীর ফুল ব্যাটালিয়ান। আর এখানকার সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্সঃ
কমান্ডারের মত বড় পদগুলো তাদেরই দখলে।সংখ্যার দিক দিয়ে কর্মরত সবচেয়ে
বেশী পিসকীপার বাংলাদেশের পরে তাদেরই।তাই তাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায়
অনিচ্ছাসত্ত্বেও নানানধরনের কর্মকাণ্ডে একসাথে সক্রিয় থেকে কাজ করতে হয়।
মেজর ওয়াসেতের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা উঠে।এ প্রসঙ্গ উঠতেই উনি কেমন যেন চুপসে গেল,তার ভিতর একটা অনুশোচনা আর অসহায়ত্ব বোধ দেখতে পেলাম, সে বলল পাকিস্তানের দুটো অংশ নিয়ে যে সময় যুদ্ধ হয়েছিল তার অনেক পর আমার জন্ম ,নিশ্চয় তুমিও সে সময় ছিলেনা। আমরা এ প্রজন্মের পাক আর্মিরা দারুন ভাবে বিশ্বাস করি তোমরা আমাদের ব্রাদার এবং তা এখনও। সেই সময় পাকিস্তান আর্মি এবং সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে পথে হেঁটেছিল সেটা কথনই সঠিক ছিলনা,তিনি আইয়ুব খানের একটা কথা উদ্বৃত্তি করে বললেন, বাংলার এই বিভাজন ছিল অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য। পূবৃ পাকিস্তানের বিশাল জনগোষ্ঠির বিশ্বাস এবং গভীর চেতনায় আস্থা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শত্রু আর তাদের থেকে যে কোন প্রকারেই হউক মুক্ত হতে হবে।তখনকার শাসকেরা এটা উপলব্দি করে পূর্বঃপাকিস্তান তথা বাংলাদেশ কে যদি মেন নিত এবং শান্তিপূর্নঃভাবে বাঙালীদের চলে যেতে দিত তাহলে এত সংঘাত এত প্রাণহানী হত না,কিছু উচ্চভিলাষী সেনা কর্মঃকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও সম্প্রদায় বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোলান্ড সহ অন্যান্য দেশ আমাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায় আর ভারত তো আমাদের বিপক্ষে তোমাদের হয়ে যুদ্ধই ঘোষনা করে।
ডিসেম্বরের এই মাসে মেজর ওয়াসেতের সহজ সরল স্বীকারোক্তি মনকে দারুন ভাবে নাড়া দেয় ,উদ্দিপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আর ভাবি এটা কি তাদের না মনের কথা ।পাকিস্তান আর্মির বর্তঃমান প্রজন্মের অনেক তরুন অফিসারকে খুব কাছ থেকে জেনেছি তাদের ভিতর সবসময় একটা অপরাধবোধ আর অনুশোচনা কাজ করে।আমাদের বাংলাদেশের সকল অফিসার ফোর্সের সাথে তারা সবসময় খুব ভাল সম্পর্কঃ রাখতে সচেষ্ট থাকে।
ইয়ামুসুক্রুর আমাদের মূল ইউনিটের পাশেই পাকিস্তানের বিশাল ট্রান্সপোর্টঃ ব্যাটালিয়ান,আইভরি কোষ্টে জাতিসঙ্গের সকল দপ্তরকে ট্রান্সপোর্টঃ সুবিধা দেওয়াই মূলত তাদের কাজ,তাদের সাথে আমাদের অপারেশনাল ,এডমিনিস্ট্রিটিভ ও নানামুখি বিভিন্ন কাজে সারাক্ষন ইন্টারেকশান হয়।তাদের পূর্বর্তী কমান্ডার লেঃকর্ণেল দুরানীর আন্তরিকতা আতিথিয়তা ও সহযোগিতা সকল বাংলাদেশীদের মুগ্ধ করেছিল।ব্রিগেডিয়ার নাফিস যিনি আইভরি কোষ্টের সেক্টের ইস্ট কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন তার জন্ম হয়েছিল বরিশালে,তিনি সারাক্ষন বাংলাদেশ বলে অন্তপ্রান।তার অফিস ছিল বুয়াকে তে,সেখানে পাকিস্তানের একটা ব্যাটালিয়ান থাকতেও তিনি প্রায় সময় পুলিশ কন্টিনজেন্টের মসজিদে নামাযে যেত,অফিসারদের সাথে ডাইনিং এ খেতে বসে যেত,আসা যাওয়ার পথে বাংলাদেশী যার সাথেই দেখা হত দাড়িয়ে হ্যান্ডশেক আর কুশলাদী জিজ্ঞাসা করে বলত আমার জন্ম কিন্ত বাংলাদেশে।দারুন মানুষ ছিলেন তিনি,মাস তিনেক পূর্বে মিশন শেষ করেছেন।
আইভরিকোষ্টের সবচেয়ে রিমোট্ রিস্কি আর খারাপ আবহাওয়ার জায়গা তাইই ক্যাম্পে পাকিস্তান ইন্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের সাথে আমার দুই মাস কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।ওদের কমান্ডার ছিল একজন মেজর, সাথে দুইজন ক্যাপ্টেন (আব্দুল্লাহ আর একজন ডাক্তার ) আর পঞ্চাশ জনের মত ফোর্সঃ এনসিও।আমি ছিলাম আমাদের ত্রিশ জন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে,আমাদের কোন ডাক্তার ছিলনা,শুরুর দিকে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে আর ম্যালেরিয়ার প্রকোপে আমাদের অনেক সদস্য অসুস্হ্য হযে পরে।এখানে মরক্কো আর্মি ব্যাটালিয়ানেরও এক প্লাটুন সৈন্য আমাদের সাথে কাজ করত,তাদের বেশ কয়েকজন ডাক্তার আর ছোট একটা হাসপাতালও ছিল এই ক্যাম্পে।কিন্ত বলতে খারাপ লাগছে মরক্কো মুসলিম দেশ আর তাদের সাথে আমাদের কোন অতীত ইতিহাস নেই ক্যাম্পের এই ক্রাইসিস দিনগুলিতে তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের নৈতিক বা মানসিক সহয়েগিতা পাওয়া তো দূরের কথা সবসময় অসহযোগিতা আর আমাদের লোকদের নামে অভিযোগ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
তাইই ক্যাম্পের গুজব আর আতঙ্কের দিনগুলোতে আমাদের সদস্যদের মানসিক ভাবে দৃঢ় আর চাঙা রাখা এবং অসুস্থ্য সদস্যদের চিকিৎসা সেবা, শুষ্রুষা অপরিহার্য ছিল।পাকিস্তানী ডাক্তার আর নার্সিং এটেন্ডেন্টদের আন্তরিকতা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা,যে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় তাদেরকে সবসময় তৎপর দেখা গেছে।আমাদের ফোর্সঃ আর এনসিও দের পাশেই তাদেরও থাকার তাবু ছিল,সবাই মিলেমিশে একত্রে ইবাদত খানায় নামায পরা,গেমস খেলা বাথরুম ব্যবহার থেকে শুরু করে রান্নার যাবতীয় কাজ একসাথে করা হয়েছে কথনও তাদের সাথে বৈরী বা তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি।একবার ইন্সেপেকশান টীম এসে দুই রান্না ঘরের মাঝখানে পার্টিশান দিয়ে পৃথক করার জন্য বলা হলে তাদের মন খারাপ এবং কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি আমাদের সকলের মনে রেখাপাত করে।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ ছিল কোরআনের হাফেজ,পুরো রমযানে মরক্কো মসজিদে খতম তারাবিহ পরিয়েছে আর ঈদের জামতেও সে ইমামতি করেছে।বাংলাদেশী অফিসার আর ফোর্সঃদের ব্যাপারে তার আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত,তার বাবাও আর্মি অফিসার ছিলেন,এবং চাকুরীর অনেকট সময় নাকি বাংলাদেশে কাটিয়েছে,যদিও আব্দুল্লাহর বাংলাদেশে কথনও যাওয়া হয়নি তারপরও বাংলাদেশ ,পূর্বঃপাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অনেক বিষয় জানা আছে, এ ব্যাপারে কথা উঠলেই তার ভিতরেও একটা গভীর ক্ষত আছে বুঝা যায়্ এবং চোখে মুখে অনুশোচনা ফুঠে উঠে।
যদিও স্বাধীনতার যুদ্ধের অনেক পর আমার জন্ম তারপরও যখনই আইভরি কোষ্টে পাক আর্মির উর্দি পরা কোন সদস্যকে দেখি তখন প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভিষীকা ময় দিনগুলির কথা মানসপটে ভেসে উঠে, কল্পনা করি ২৫শে মার্চের কালোরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক ধ্বংসযজ্ঞের। চোখের সামনে দেখি নয় মাসব্যপীগণহত্যা,ধর্ষঃণ,অগ্নিসংযোগ,লাস আর লাস।চিন্তা করে হিসাব মেলাতে পারিনা এত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী ,যাদের ভিতর এত প্রফেশনালিজম স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে কিভাবে প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে – যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী – ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে।স্মৃতির মানসে এও ভেসে উঠে আজকের এই দিনে বর্বঃর পাশবিক ও নৃশংস পাক আর্মি উর্দি পরিহিত প্রায় এক লাখ পশু আত্মসমর্পঃন করে আমাদের কাছে আর পরিসমাপ্ত হয় কাপুরুষতা ও অমানবিকতার চরম নৃশংস ও রোমহর্ষঃক কলঙ্কময় ও ন্যাক্কারজনক অধ্যায়ের।
এত কিছুর পর পাকিস্তান এবং পাক আর্মি তাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে হতে পারে এটাও তাদের এক ধরনের পলিসি বা প্রফেশনালিজম,ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কঃ কখনোই ভাল ছিলনা,দুর্দিনের পরীক্ষিত বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ওসামা বিন লাদেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে ভাল সম্পর্কঃ আছে বলা যাবেনা। দেশের ভিতরে বেশ কিছু অভ্যন্তরীন বিষয়েও তারা নাজুক অবস্হায় রয়েছে।বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভুমিকা পাকিস্তানের ইতিহাসে একটা কুখ্যাত অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আছে হয়ত বা বর্তমান প্রজন্মের পাক আর্মি অফিসার তার দায় ভার নিতে চায়না,তার জন্য ইমেজ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার নিমিত্তে চেষ্টার অংশ হিসাবে সবার সাথে সম্পর্কঃ উন্নয়নে বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্হাপনে তারা জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ।আইভরি কোস্ট ছাড়াও অন্যান্য যেসব দেশে পাকিস্তানের শান্তিরক্ষী সৈন্য মোতায়েন আছে সেখানেও তারা তাদের একটা ভাল অবস্হান তৈরীতে সুসম্পর্কঃ গড়তে সর্বঃদা সচেষ্ট রয়েছে বলে জানা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অতীত ইতিহাস নিয়েই পাক আর্মির সাথে একত্রে কাজ করছে। পাকিস্তানীরা সম্পর্কঃ গড়ছে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তুলছে সাহায্য সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্হিতিশীলতায় উভয় দেশ ভুমিকা রাখছে।শান্তি রক্ষী মিশনে পাকিস্তানীদের উপেক্ষা করারও কোন অবকাশ নেই।একসাথে কাজ করতেই হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার স্বপক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চক্র বা যুদ্ধপরাধী এ চক্রে ঘুর্ণায়মান থেকেই যাচ্ছে। কিন্ত এটাতো শ্বাশত,মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বুকে স্বপ্ন ছিল, মনে জোর ছিল, জাতির ছিল প্রেরণা। আমাদের নেতা ছিল একজনই—অটুট, আপসহীন, দৃঢ়নিবদ্ধ—যিনি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল ভূখণ্ডে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মতো বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে একটি মাত্র উদ্দীপন-মন্ত্র ধ্বনিতে গ্রথিত করেছিলেন এবং একাত্তরে বাংলার সব শ্রেণী-পেশার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-তরুণ-নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শিক মণ্ডলে ধ্রুবতারার মতো অবস্থান করে বিজয়ে আমাদের উত্তীর্ণ করেছিলেন।তবে কেনই বা আজ এত বিভক্তি সবকিছুতে কেনই বা এত রাজনীতিকরণ।মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির উর্ধ্বে নিয়ে এবং এর বিরোধী সকল অশুভ শক্তি চিহ্নিত হয়ে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ হবে,ভবিষ্যতের পথচলায় নিত্যপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে এ আশাবাদ সকলের।সুন্দর, আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে এবং তা আমাদের সকলের কর্মে ও প্রবর্তনায়, স্বপ্নে ও বাস্তবতায় আবার সত্য হয়ে উঠবে ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মত আর আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের সংগ্রামে পথচলার প্রেরণা জোগাবে একাত্তরের এই দিনগুলো।
(মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ)
আইভরিকোষ্ট থেকে
মেজর ওয়াসেতের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা উঠে।এ প্রসঙ্গ উঠতেই উনি কেমন যেন চুপসে গেল,তার ভিতর একটা অনুশোচনা আর অসহায়ত্ব বোধ দেখতে পেলাম, সে বলল পাকিস্তানের দুটো অংশ নিয়ে যে সময় যুদ্ধ হয়েছিল তার অনেক পর আমার জন্ম ,নিশ্চয় তুমিও সে সময় ছিলেনা। আমরা এ প্রজন্মের পাক আর্মিরা দারুন ভাবে বিশ্বাস করি তোমরা আমাদের ব্রাদার এবং তা এখনও। সেই সময় পাকিস্তান আর্মি এবং সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে পথে হেঁটেছিল সেটা কথনই সঠিক ছিলনা,তিনি আইয়ুব খানের একটা কথা উদ্বৃত্তি করে বললেন, বাংলার এই বিভাজন ছিল অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য। পূবৃ পাকিস্তানের বিশাল জনগোষ্ঠির বিশ্বাস এবং গভীর চেতনায় আস্থা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শত্রু আর তাদের থেকে যে কোন প্রকারেই হউক মুক্ত হতে হবে।তখনকার শাসকেরা এটা উপলব্দি করে পূর্বঃপাকিস্তান তথা বাংলাদেশ কে যদি মেন নিত এবং শান্তিপূর্নঃভাবে বাঙালীদের চলে যেতে দিত তাহলে এত সংঘাত এত প্রাণহানী হত না,কিছু উচ্চভিলাষী সেনা কর্মঃকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও সম্প্রদায় বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোলান্ড সহ অন্যান্য দেশ আমাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায় আর ভারত তো আমাদের বিপক্ষে তোমাদের হয়ে যুদ্ধই ঘোষনা করে।
ডিসেম্বরের এই মাসে মেজর ওয়াসেতের সহজ সরল স্বীকারোক্তি মনকে দারুন ভাবে নাড়া দেয় ,উদ্দিপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আর ভাবি এটা কি তাদের না মনের কথা ।পাকিস্তান আর্মির বর্তঃমান প্রজন্মের অনেক তরুন অফিসারকে খুব কাছ থেকে জেনেছি তাদের ভিতর সবসময় একটা অপরাধবোধ আর অনুশোচনা কাজ করে।আমাদের বাংলাদেশের সকল অফিসার ফোর্সের সাথে তারা সবসময় খুব ভাল সম্পর্কঃ রাখতে সচেষ্ট থাকে।
ইয়ামুসুক্রুর আমাদের মূল ইউনিটের পাশেই পাকিস্তানের বিশাল ট্রান্সপোর্টঃ ব্যাটালিয়ান,আইভরি কোষ্টে জাতিসঙ্গের সকল দপ্তরকে ট্রান্সপোর্টঃ সুবিধা দেওয়াই মূলত তাদের কাজ,তাদের সাথে আমাদের অপারেশনাল ,এডমিনিস্ট্রিটিভ ও নানামুখি বিভিন্ন কাজে সারাক্ষন ইন্টারেকশান হয়।তাদের পূর্বর্তী কমান্ডার লেঃকর্ণেল দুরানীর আন্তরিকতা আতিথিয়তা ও সহযোগিতা সকল বাংলাদেশীদের মুগ্ধ করেছিল।ব্রিগেডিয়ার নাফিস যিনি আইভরি কোষ্টের সেক্টের ইস্ট কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন তার জন্ম হয়েছিল বরিশালে,তিনি সারাক্ষন বাংলাদেশ বলে অন্তপ্রান।তার অফিস ছিল বুয়াকে তে,সেখানে পাকিস্তানের একটা ব্যাটালিয়ান থাকতেও তিনি প্রায় সময় পুলিশ কন্টিনজেন্টের মসজিদে নামাযে যেত,অফিসারদের সাথে ডাইনিং এ খেতে বসে যেত,আসা যাওয়ার পথে বাংলাদেশী যার সাথেই দেখা হত দাড়িয়ে হ্যান্ডশেক আর কুশলাদী জিজ্ঞাসা করে বলত আমার জন্ম কিন্ত বাংলাদেশে।দারুন মানুষ ছিলেন তিনি,মাস তিনেক পূর্বে মিশন শেষ করেছেন।
আইভরিকোষ্টের সবচেয়ে রিমোট্ রিস্কি আর খারাপ আবহাওয়ার জায়গা তাইই ক্যাম্পে পাকিস্তান ইন্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের সাথে আমার দুই মাস কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।ওদের কমান্ডার ছিল একজন মেজর, সাথে দুইজন ক্যাপ্টেন (আব্দুল্লাহ আর একজন ডাক্তার ) আর পঞ্চাশ জনের মত ফোর্সঃ এনসিও।আমি ছিলাম আমাদের ত্রিশ জন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে,আমাদের কোন ডাক্তার ছিলনা,শুরুর দিকে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে আর ম্যালেরিয়ার প্রকোপে আমাদের অনেক সদস্য অসুস্হ্য হযে পরে।এখানে মরক্কো আর্মি ব্যাটালিয়ানেরও এক প্লাটুন সৈন্য আমাদের সাথে কাজ করত,তাদের বেশ কয়েকজন ডাক্তার আর ছোট একটা হাসপাতালও ছিল এই ক্যাম্পে।কিন্ত বলতে খারাপ লাগছে মরক্কো মুসলিম দেশ আর তাদের সাথে আমাদের কোন অতীত ইতিহাস নেই ক্যাম্পের এই ক্রাইসিস দিনগুলিতে তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের নৈতিক বা মানসিক সহয়েগিতা পাওয়া তো দূরের কথা সবসময় অসহযোগিতা আর আমাদের লোকদের নামে অভিযোগ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
তাইই ক্যাম্পের গুজব আর আতঙ্কের দিনগুলোতে আমাদের সদস্যদের মানসিক ভাবে দৃঢ় আর চাঙা রাখা এবং অসুস্থ্য সদস্যদের চিকিৎসা সেবা, শুষ্রুষা অপরিহার্য ছিল।পাকিস্তানী ডাক্তার আর নার্সিং এটেন্ডেন্টদের আন্তরিকতা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা,যে কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় তাদেরকে সবসময় তৎপর দেখা গেছে।আমাদের ফোর্সঃ আর এনসিও দের পাশেই তাদেরও থাকার তাবু ছিল,সবাই মিলেমিশে একত্রে ইবাদত খানায় নামায পরা,গেমস খেলা বাথরুম ব্যবহার থেকে শুরু করে রান্নার যাবতীয় কাজ একসাথে করা হয়েছে কথনও তাদের সাথে বৈরী বা তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি।একবার ইন্সেপেকশান টীম এসে দুই রান্না ঘরের মাঝখানে পার্টিশান দিয়ে পৃথক করার জন্য বলা হলে তাদের মন খারাপ এবং কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি আমাদের সকলের মনে রেখাপাত করে।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ ছিল কোরআনের হাফেজ,পুরো রমযানে মরক্কো মসজিদে খতম তারাবিহ পরিয়েছে আর ঈদের জামতেও সে ইমামতি করেছে।বাংলাদেশী অফিসার আর ফোর্সঃদের ব্যাপারে তার আন্তরিকতা ছিল প্রশ্নাতীত,তার বাবাও আর্মি অফিসার ছিলেন,এবং চাকুরীর অনেকট সময় নাকি বাংলাদেশে কাটিয়েছে,যদিও আব্দুল্লাহর বাংলাদেশে কথনও যাওয়া হয়নি তারপরও বাংলাদেশ ,পূর্বঃপাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অনেক বিষয় জানা আছে, এ ব্যাপারে কথা উঠলেই তার ভিতরেও একটা গভীর ক্ষত আছে বুঝা যায়্ এবং চোখে মুখে অনুশোচনা ফুঠে উঠে।
যদিও স্বাধীনতার যুদ্ধের অনেক পর আমার জন্ম তারপরও যখনই আইভরি কোষ্টে পাক আর্মির উর্দি পরা কোন সদস্যকে দেখি তখন প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভিষীকা ময় দিনগুলির কথা মানসপটে ভেসে উঠে, কল্পনা করি ২৫শে মার্চের কালোরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক ধ্বংসযজ্ঞের। চোখের সামনে দেখি নয় মাসব্যপীগণহত্যা,ধর্ষঃণ,অগ্নিসংযোগ,লাস আর লাস।চিন্তা করে হিসাব মেলাতে পারিনা এত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী ,যাদের ভিতর এত প্রফেশনালিজম স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে কিভাবে প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে – যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী – ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে।স্মৃতির মানসে এও ভেসে উঠে আজকের এই দিনে বর্বঃর পাশবিক ও নৃশংস পাক আর্মি উর্দি পরিহিত প্রায় এক লাখ পশু আত্মসমর্পঃন করে আমাদের কাছে আর পরিসমাপ্ত হয় কাপুরুষতা ও অমানবিকতার চরম নৃশংস ও রোমহর্ষঃক কলঙ্কময় ও ন্যাক্কারজনক অধ্যায়ের।
এত কিছুর পর পাকিস্তান এবং পাক আর্মি তাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে হতে পারে এটাও তাদের এক ধরনের পলিসি বা প্রফেশনালিজম,ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কঃ কখনোই ভাল ছিলনা,দুর্দিনের পরীক্ষিত বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ওসামা বিন লাদেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে ভাল সম্পর্কঃ আছে বলা যাবেনা। দেশের ভিতরে বেশ কিছু অভ্যন্তরীন বিষয়েও তারা নাজুক অবস্হায় রয়েছে।বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভুমিকা পাকিস্তানের ইতিহাসে একটা কুখ্যাত অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আছে হয়ত বা বর্তমান প্রজন্মের পাক আর্মি অফিসার তার দায় ভার নিতে চায়না,তার জন্য ইমেজ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার নিমিত্তে চেষ্টার অংশ হিসাবে সবার সাথে সম্পর্কঃ উন্নয়নে বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্হাপনে তারা জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ।আইভরি কোস্ট ছাড়াও অন্যান্য যেসব দেশে পাকিস্তানের শান্তিরক্ষী সৈন্য মোতায়েন আছে সেখানেও তারা তাদের একটা ভাল অবস্হান তৈরীতে সুসম্পর্কঃ গড়তে সর্বঃদা সচেষ্ট রয়েছে বলে জানা যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অতীত ইতিহাস নিয়েই পাক আর্মির সাথে একত্রে কাজ করছে। পাকিস্তানীরা সম্পর্কঃ গড়ছে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তুলছে সাহায্য সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্হিতিশীলতায় উভয় দেশ ভুমিকা রাখছে।শান্তি রক্ষী মিশনে পাকিস্তানীদের উপেক্ষা করারও কোন অবকাশ নেই।একসাথে কাজ করতেই হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার স্বপক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চক্র বা যুদ্ধপরাধী এ চক্রে ঘুর্ণায়মান থেকেই যাচ্ছে। কিন্ত এটাতো শ্বাশত,মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বুকে স্বপ্ন ছিল, মনে জোর ছিল, জাতির ছিল প্রেরণা। আমাদের নেতা ছিল একজনই—অটুট, আপসহীন, দৃঢ়নিবদ্ধ—যিনি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল ভূখণ্ডে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মতো বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে একটি মাত্র উদ্দীপন-মন্ত্র ধ্বনিতে গ্রথিত করেছিলেন এবং একাত্তরে বাংলার সব শ্রেণী-পেশার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-তরুণ-নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শিক মণ্ডলে ধ্রুবতারার মতো অবস্থান করে বিজয়ে আমাদের উত্তীর্ণ করেছিলেন।তবে কেনই বা আজ এত বিভক্তি সবকিছুতে কেনই বা এত রাজনীতিকরণ।মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির উর্ধ্বে নিয়ে এবং এর বিরোধী সকল অশুভ শক্তি চিহ্নিত হয়ে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শেষ হবে,ভবিষ্যতের পথচলায় নিত্যপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে এ আশাবাদ সকলের।সুন্দর, আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে এবং তা আমাদের সকলের কর্মে ও প্রবর্তনায়, স্বপ্নে ও বাস্তবতায় আবার সত্য হয়ে উঠবে ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মত আর আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের সংগ্রামে পথচলার প্রেরণা জোগাবে একাত্তরের এই দিনগুলো।
(মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ)
আইভরিকোষ্ট থেকে
No comments:
Post a Comment