মুক্তবাসের
রক্তস্রোত
- আবু
বকর সিরাজী
রক্তস্রোত
যেন চিরকালের বহমান ঝর্নাধারা,
যার
চলার গতিতে ভাটা নেই,
বিরাম
নেই। এই প্রবল গতির রক্তস্রোতকে
বেগবান করেছে মুক্তবাসের
অভিশপ্ত জীবন,
জারি
করে চলেছে খুনের নতুন নতুন
দরিয়া। রক্তের প্লাবনে ভেসে
যাচ্ছে মানুষের হৃদয়পট। রক্তের
এই জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ছে
মাতৃক্রোড়ে,
বিধস্ত
হচ্ছে মানব-উপকূল,
ধ্বংস
হচ্ছে অসংখ্য পরিবার,
ভাঙছে
হাজারও সংসার।
এবারের
নারকীয় নির্মম ঘটনাটি ২রা
অক্টোবর ২০১০ইং সালের। দিনটি
বৃহস্পতিবার। চট্টগ্রামের
কোতোয়ালী থানাধীন আমিরবাগ
এলাকায় এদিন সংঘটিত হয় সেই
নির্মম হত্যাকাণ্ডটি। মুক্তবাসের
এক বিষাক্ত পরিণতির শিকার হন
ভার্সিটির এক ছাত্রী। নাম
সারিমা রহমান মৃধাতা। বয়স
ঊনিশ। বিচিত্রময় এই ধরণীর
অন্য দশটি বস্তুর সঙ্গে আরেকটি
তিক্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত
হন তিনি। সখ্য গড়েন এর সঙ্গে।
তার
নাম প্রেম। মুক্তবাসের এই
সমাজে যাকে বাধা দেয়া বা
প্রতিরোধ করার সাধ্য নেই কারও।
ইচ্ছাও বোধ হয় নেই অনেকের।
সমাজ-সংসার
ভাঙলেও এবং সভ্যতার ‘রোমনগরীটা’
পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেলেও বোধ
হয় তারা তৃপ্তির বাঁশি বাজাতে
থাকবেন পোড়োবাড়ির সামনে!
কত
মৃধাতা যে রক্ত দিলে জেগে উঠবে
এই সমাজ,
সেই
কঠিন প্রশ্নটার উত্তর জানা
নেই কারও। যা হোক,
এবার
আসি আসল কথায়।
সারিমা
রহমান মৃধাতা চট্টগ্রমের এক
ভার্সিটির ছাত্রী। কলেজ পড়ার
সময়েই ‘একস্ট্রা ডিউটি’ হিসেবে
মাথায় তুলে নেন প্রেম-ভালোবাসার
কঠিন বোঝা। জড়িয়ে পড়েন সৌরভ
নামের এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের
সম্পর্কে। বেশ কিছুদিন প্রেম
চালিয়ে নেবার পর যে কোনও কারণেই
হোক তাদের মধ্যে মনোমালিন্যের
ঘটনা ঘটে। যার ফলে সৌরভ-সারিমার
সম্পর্কের অবনতি হয়। তরুণ
হৃদয়ের প্রেমের উত্তালতার
ঝড় এখন অনেকটাই মৃদমন্দ বাতাসের
মতো। তবে থেমে যাওয়া উচ্ছ্বাসের
ঝড় ফাটল সৃষ্টি করেছে তাদের
প্রেমমন্দিরে। আর সেই ফাটল
সারানোর জন্যই সৌরভ একটা
উদ্যোগ হাতে নিলেন। পুরনো
সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে
সারিমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে
গেলেন। সম্পর্ককে স্বাভাবিক
করতে প্রেমিক-প্রেমিকার
প্রেমের জুয়ার মেলা বসল।
কেননা,
মেহেদিবাগের
৬৬/ডি
নম্বর পাঁচতলা ভবনের ছাদে এই
ঝুটি ছাড়াও উপস্থিত হলেন আরেক
ঝুটি ইশতিয়াক সাবাহ ও তার
প্রেমিক ইয়াসিন (ছদ্মনাম)।
সেই জুয়ার মেলা থেকেই প্রেমিকা
সারিমাকে পুনরায় প্রেমবন্ধনে
ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছিলেন
সৌরভ। যুগল-ঝুটি
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আলাপ
ও গল্পের আসর জমালেন ওই ছাদে।
কিন্তু
সৌরভের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
সারিমা রাজি হন নি বাসি জিনিস
পুনরায় ভেজে খেতে। প্রেমের
এই গরম বাজারে কে-ই
বা চায় বাসি প্রেম নিয়ে মাথা
ঘামাতে?
তাই
সারিমাও চান নি এই সম্পর্কটি
তাজা করতে। কিন্তু তার এই
সিদ্ধান্ত নির্মম করে তোলে
সৌরভকে। ভেতর থেকে উদ্গীরণ
করেন তার বিষাক্ত সিদ্ধান্তটা।
ছাদে গল্প বলার এক ফাঁকে দূরে
ও আড়ালে নিয়ে যান তিনি সারিমাকে।
কথা কাটাকাটি ও বাক্যবিনিময়ের
এক পর্যায়ে বড় সাইজের একটি
ছুরি দিয়ে সারিমাকে আঘাত করেন
সৌরভ।
হোক
না সাবেক প্রেমিক!
প্রেম
সাবেক হয়েছে বলে হৃদ্যতাটাও
একেবারে সালাম করে চলে গেছে
তা ভাবেন নি সারিমা। তাই তার
তরফ থেকে এত বড় একটি আঘাতের
প্রত্যাশা করেন নি তিনি।
স্নেহ-ভালোবাসা
আর পৃথিবীর তাবত দয়া ও আনুকূল্য
পাওয়ার দাবিদার যারা,
তারা
এত বড় আঘাত সইতে পারে না। তাই
একজন যুবকের পূর্ণ শক্তির
আঘাত সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব
হলো না। আঘাতের তীব্রতায় সঙ্গে
সঙ্গে ছাদের উত্তপ্ত বিছানায়
শুয়ে পড়লেন তিনি। গুরুতর আহত
অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হলে
চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা
করেন।
প্রেম
নামের এক ঝঞ্ঝাবায়ু এভাবে
একটি সম্ভাবনাময় জীবন প্রদীপকে
অসময়ে নিভিয়ে দিয়ে যায়। সবচেয়ে
ভারী বোঝা-
পিতার
কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করতে
হলো ব্যবসায়ী পিতা মিজানুর
রহমানকে। আর মা গাইনি ডাক্তার
শাহনাজ আহমাদ সন্তানের রক্তাক্ত
লাশ দেখে কেঁদে বুক ভাসালেন।
পুলিশ
জানিয়েছে,
এই
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে
প্রেমঘটিত কারণে এবং
পূর্বপরিকল্পিতভাবে। সৌরভ
প্রতিজ্ঞা করেছিলেন প্রেমের
সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করতে
ব্যর্থ হলে সারিমার সঙ্গে
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
একারণে ছাদে আসার আগে থেকেই
ছুরি জোগাড় করে রাখা হয়েছিল।
যথাসময়ে যার সদ্ব্যবহার
করেছিলেন তিনি। অবশ্য তিনি
প্রেমিকার হৃদয় আকৃষ্ট করতে
নিজেই আত্মহত্যার প্রতিজ্ঞা
নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু প্রেমিকার
উপেক্ষা তাকে ক্রুদ্ধ করে
তোলে। তাই তাকেই হত্যা করে
বসেন তিনি।
কত
নিষ্ঠুর প্রেমিক সৌরভ!
আর
কত নিষ্ঠুরতা এই প্রেমের
মধ্যে!
প্রেমিকাকে
যদি ভালোইবাসতি,
তাহলে
তাকে না পেলে বিরহের ফুলচন্দন
নিক্ষেপ করবি!
সে
জায়গায় ছুরির ঘা!
এই
ঘটনাটিও আমাদেরকে মুক্তবাস,
অবাধ
জীবন ও বেপর্দার বিষাক্ত
ছোবলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বোন
সারিমা!
তোমার
জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। বোন!
তুমি
যদি পর্দার বিধান পালন করতে,
আল্লাহর
বিধান মোতাবেক চলতে,
তাহলে
আমার বিশ্বাস তোমাকে নির্মম
পরিণতির শিকার হতে হতো না।
পিশাচীয় উন্মত্ততা নিয়ে তোমার
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত না
সৌরভ।
একজন
ঘোর পর্দাবিরোধীও একথা স্বীকার
করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না যে,
পর্দালঙ্ঘন
তাকে এই পরিণতির দিকে নিয়ে
গেছে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে
এই বিশ্বাস আরেকটু পোক্ত হচ্ছে
যে,
মুক্তবাস
এভাবেই জীবন থেকে জীবন কেড়ে
নেয়।
কন্যা
হারিয়ে যে মা-বাবা
আজ কষ্টের আগুনে দগ্ধ হচ্ছেন,
সেই
আগুনের ইন্ধন কি তারা নিজেরাই
সরবরাহ করেন নি?
অবুঝ
কিশোরী কন্যাকে প্রেমনিবেদন
করতে দেখে তারা নীরব থাকলেন
কেন?
মেয়েটি
যখন প্রেমের সর্বনাশা ফাঁদে
পা দিচ্ছিলেন,
তখন
তারা গাফেল থাকলেন কেন?
এই
গাফলতির যে পরিণতি,
তা
কি আজ তারা বরদাশত করতে পারছেন?
কিংবা
অন্য মা-বাবারাও
কি পারবেন এধরনের পরিণতি সহ্য
করতে?
যদি
না পারেন,
তাহলে
উচিত এই পথ পরিহার করা এবং
আল্লাহর পথে ফিরে আসা।
No comments:
Post a Comment