সম্ভ্রমের
ধ্বংসাবশেষ
-আবু
বকর সিরাজী
সংসারের
একঘেয়েমি কাটাতে কিংবা নাড়ীর
টানে সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে
সহোদরা দুই বোন বেড়াতে এলেন
চাচার বাসায় নারায়ণগঞ্জ জেলায়।
ঘটনাটি ২০১০ ইং সালের শুরুর
দিকের। কিন্তু তাদের এই বেড়ানোটা
কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের
মুক্তজীবনের সঙ্গে যুক্ত
হয়েছিল ঘুণেধরা এই সমাজের
লাম্পট্যের ঘৃণিত ইতিহাস।
লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল তাদের
স্বাভাবিক জীবন। সময়ের বহু
আগেই রচিত হয়েছিল তাদের স্বপ্নের
সমাধি। পঠিত হলো স্মরণ-অযোগ্য
এক ন্যাক্কারজনক ইতিহাস।
সুমা-সুষ্মা
(ছদ্মনাম)-দের
বড় স্বপ্ন ছিল। স্বামীকে তারা
উপহার দেবে নিষ্কলঙ্ক সতীত্ব।
নির্ভেজাল
গর্ভে স্বামীর ঔরসে জন্ম হবে
আদরের সন্তান। সন্তান আর
স্বামীকে নিয়ে গড়বেন
সুখের সংসার। আরও কত কী সুখস্বপ্ন!
কিন্তু
তাদের ভুল পদক্ষেপে আর ভঙ্গুর
সমাজের চিটে লোকদের রিপুর
কাঠিতে কামনার আগুন জ্বলে
ওঠায় তাদের সেই সুখনীড় নিমিষেই
জ্বলে ছাই হয়ে গেল। তাদের
জীবনের এখানে-সেখানে
কেবল পাশবিকতার ধ্বংসাবশেষ
আর লাঞ্চনার আবর্জনা। তাদের
দেহের গাটে-গাটে
এখন কলঙ্কের অদৃশ্য দাগ।
নরপশুদের কামনার নখরাঘাত।
প্রিয় পাঠক!
ভূমিকাটা
বড় হয়ে গেল। চলুন,
এবার
ঘটনার মূলে ফিরে আসা যাক।
সুমা-সুষ্মা
বেড়াতে এলেন চাচার বাসায় সুদূর
নারায়ণগঞ্জে। উত্তরবঙ্গ থেকে
নারায়ণগঞ্জ আসার পথে দুচোখ
ভরে তারা দেখলেন প্রকৃতির
সৌন্দর্য। দুই ধারে সবুজের
গালিচা। মুক্তবিহঙ্গদের
ছোটাছুটি-কোলাহল।
এসব দৃশ্য হয়ত তাদেরকে অন্য
কিছু ভাবতে সহায়তা করেছিল।
তারা নিজেরাও হতে চেয়েছিলেন
বিহঙ্গদের মতো মুক্তবাসিনী।
এসব অলীক ভাবনার মধ্যে ডুব
দিয়ে তারা ভুলে গেলেন তাদের
সৃষ্টিমাহাত্ম্যের কথা।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠজীবের মর্যাদাকে
নিয়ে গেলেন জীবজন্তুদের স্তরে।
আর ভুলে গেলেন মুক্তবাসের
অভিশাপের কথা। নির্দয় সমাজের
লাম্পট্যের আধিক্যতার কথা।
আর
ভুলে গেলেন অথবা কোনোদিন হয়ত
কানেই পড়ে নি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কবাণীর
কথা,
যাতে
তিনি নারীদেরকে সম্ভ্রম রক্ষার
কৌশল বাতলে দিয়েছেন। করেছেন
তাদেরকে অনাহুত বিপদ থেকে
সতর্ক,
সজাগ।
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ
করেন-
اِنَّ
الْمَرْأةَ عَوْرَةٌ اِذَا خَرَجَتْ
اِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ -
‘নারী
হলো পর্দাবৃত থাকার মানুষ।
সে যখন পর্দা থেকে বের হয়ে আসে
শয়তান,
তখন
তার দিকে খারাপভাবে উঁকি দিয়ে
তাকায়।’
[মুসনাদ
বাযযার :
২০৬৫;
সহীহ
ইবন খুযাইমা :
১৬৮৫]
শয়তান
শুধু নিজেই উঁকি দেয় না,
বখাটে
ইভটিজারদেরকেও উস্কে দেয়।
সুমা-সুষ্মা
এই হাদীসের সত্যতার চাক্ষুসদর্শী
হলেন নিজেদের অসতর্কতার কারণে।
চাচার বাড়ি থেকে বিকেলবেলা
বেড়াতে গেলেন আরেক আত্মীয়ের
বাড়ি। তাদের এই গমনপথে তাদের
দিকে উঁকি দিয়ে রাখল শয়তান ও
তার দোসররা। সুমা-সুষ্মা
নিজেরাই যাদের পথ সহজ করে
দিয়েছিলেন।
অপরিচিত
জায়গা,
অপরিচিত
মানুষের মধ্যে সেই আত্মীয়ের
বাড়ি থেকে ফিরতি পথ ধরলেন রাত
আটটায়। ফেরার পথটিও অনুকূল
ছিল না। ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে
অন্ধকার পথে চলতে হচ্ছিল
তাদের। আর ঠিক সেসময়েই ঘটল
তাদের জীবনের সবচেয়ে সর্বনাশা
ঘটনাটা। নিজেদের হাতে রচিত
দুর্ভাগ্য বিভীষিকা হয়ে তাদের
সামনে আত্মপ্রকাশ করে। ঝোঁপের
আড়ালে লুকিয়ে থাকা হিংস্রদানবগুলো
ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। চাচাকে
গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দুই
বোনকে দুই দিকে নিয়ে গিয়ে
তাদের লাঞ্ছিত ও সম্ভ্রমহানী
করে।
একই
সঙ্গে দুইবোনের সম্ভ্রমহানী!
তাও
আবার আপন চাচার সামনে!
এর
চেয়ে নিষ্ঠুর,
নির্মম
আর করুণ দৃশ্য আর কী হতে পারে?
লম্পটদের
রিপুর তাড়না যতক্ষণে নিস্তেজ
হয়ে এসেছে,
ততক্ষণে
সব শেষ হয়ে গেছে সুমা-সুষ্মাদের।
সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার ও সম্মানজনক
জীবন যাপনের স্বপ্নের সমাধি
ঘটেছে ততক্ষণে।
ঘটনাটি
যাতে ফাঁস না হয়,
তার
জন্য বখাটেরা স্থানীয় বাসিন্দাদের
সঙ্গে সমঝোতা করে। সমঝোতায়
দুই বোনের সম্ভ্রমের মূল্য
নির্ধারণ করা হয় দশ হাজার
টাকা!
হায়
সমাজ!
দুইজন
যুবতী নারীর সম্ভ্রমের মূল্য
মাত্র দশ হাজার টাকা!
ইজ্জতের
বাজারে সম্ভ্রমের মূল্য এত
কম?
আচ্ছা,
নারীর
ইজ্জতের মূল্য পরিশোধ করা
যায়?
দশ
হাজার টাকায়?
দশ
লক্ষ টাকায়?
দশ
কোটি টাকায়?
যা
হোক,
অভাগী
সুমা-সুষ্মারা
সমঝোতার চুক্তি মানেন নি।
যাদের স্বপ্নই ধূলিস্মাৎ হয়ে
গেছে,
তাদের
কাছে সমঝোতার মূল্য কী?
তারা
কি পারেন কষ্টের আগুন চেপে
রাখতে?
তাই
বিচারের প্রার্থনায় আইনের
লোকদের কাছে ছুটে গেছেন আর
লুণ্ঠিত সম্ভ্রমকে সওদা বানিয়ে
যারা ব্যবসা করে,
সেই
মিডিয়া রূপ-রস
চড়িয়ে এই গল্পকে আকর্ষণীয়
আকারে পেশ করে পুরো জাতির
সমানে তুলে ধরে সুমা-সুষ্মাদের
জীবনকে আরও বিষিয়ে তুলেছে।
আজ তারা জাতির সামনে মুখ
দেখানোরও অধিকার হারিয়েছে
এই মিডিয়ার কল্যাণে(?)!
আমাদের
জানাশোনার মধ্যে সংঘটিত হলো
এমন একটি ঘটনা,
যার
ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। আমরা
ইচ্ছা করলে হয়ত সুমা-সুষ্মাদেরকে
সমবেদনা জানাতে পারি। কেউ
ইচ্ছা করলে আর্থিক সাহায্যও
করতে পারি। কিন্তু যে ক্ষতি
হয়েছে,
তাতে
তাদের ক্ষতির ভার কমবে না।
তাই তাদের এই করুণ পরিণতি
কেবলই ইতিহাস। আর আমরা ইতিহাস
থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কেননা,
ইতিহাস
হলো মানুষের সার্বক্ষণিক
উপদেষ্টা। এর থেকে সর্বদা
উপদেশ নেয়া যেতে পারে। আমরা
এখান থেকে যে শিক্ষা নিতে পারি
তাহলো;
সুমা-সুষ্মারা
এই পরিণতির শিকার হয়েছেন মূলত
দুটি কারণে। এক.
পর্দাহীনতা,
দুই.
অসতর্কতা।
অথচ
এদুটি বিষয়েই কিন্তু শরীয়তের
সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
এই দিকনির্দেশনা মানলে আমাদের
দৃঢ়বিশ্বাস এই যে,
তাদেরকে
এই পরিণতির শিকার হতে হতো না।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার
প্রমাণিত হলো,
আসল
সুখ ‘অবরোধবাসিনী’তে;
‘মুক্তবাসিনী’তে
নয়।
No comments:
Post a Comment